খুলনা, বাংলাদেশ | ১৫ চৈত্র, ১৪৩০ | ২৯ মার্চ, ২০২৪

Breaking News

বিজ্ঞানমনষ্কতা প্রতিষ্ঠার লড়াই ও গ্যালিলিও গ্যালিলে

ড. বিশ্বম্ভর মণ্ডল

জন্ম ১৫৬৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী ইতালিতে, মৃত্যু ৮ জানুয়ারী ১৬৪২। বাড়ি থেকে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল ডাক্তারিতে, কিছুদিন পড়ে তিনি ডাক্তারি ছেড়ে গণিত নিয়ে ভর্তি হন । পেশায় ছিলেন অধ্যাপক। গণিতে অধ্যাপনা জীবন শুরু পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে । পরবর্তীতে পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন ।

এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, কুসংস্কার জন্ম নেয় অজ্ঞানতা থেকে। সমাজ ব্যবস্থায় মানুষের জীবন-জীবিকা নিয়ে অনিশ্চয়তা, অসাম্য বেশি থাকলে ভাগ্য নির্ভরতা বেড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। বিজ্ঞান, যুক্তি, বুদ্ধি লজ্জায় মুখ লুকোয় যে সমাজ ব্যবস্থায়, সেখানে ধর্মকে শাসক তার নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে শুরু করবে এটাই তো স্বাভাবিক। অধিকাংশ শাসক কখনোই চায় না মানুষ তার জীবন জীবিকা, শিক্ষা, স্বাস্থের অধিকার নিয়ে শাসককে প্রশ্ন করতে শুরু করে দিক। বিজ্ঞানমনষ্কতা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে গ্যালিলিওর ভূমিকার একটি মুখবন্ধ তুলে ধরার চেষ্টা করছি ।

২০০০ বছর ধরে অ্যারিস্টটলের মতবাদ –উপর থেকে সব বস্তু একই গতিবেগে নীচে পড়ে না- এটাই পৃথিবীতে সত্য বলে বিবেচিত হয়েছে । গ্যালিলিও “পতনশীল বস্তুর সূত্র” প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেখালেন অ্যারিস্টটলের মতবাদ ভ্রান্ত । তিনি দূরবিন আবিষ্কর্তা ছিলেন না ঠিকই, তবে তিনিই প্রথম দূরবিনের সঠিক ব্যবহার করেছিলেন । তাঁর অন্যতম অবদান জড়ত্ববাদ আবিষ্কার । বিজ্ঞানের জগতে তিনি ‘অব্জারভেশনাল অ্যাস্ট্রোনমি’, ‘আধুনিক পদার্থবিদ্যা’, ‘বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির’ জনক হিসাবে স্বীকৃত। মহাকাশ পর্যবেক্ষণে তাঁর অবদান বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে সহায়ক হয়েছে, একইসাথে বিজ্ঞানমনষ্কতার ভিত্তিভূমি শক্তভাবে প্রতিষ্টিত হতে সাহায্য করেছে ।

তিনি প্রভাবশালী মানুষদের গোঁড়ামি, কুসংস্কারের ধারাবাহিক আক্রমণকে উপেক্ষা করে সমাজমনস্ক ও বিজ্ঞানমনস্ক কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার ও মদত দেবার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। হাজার বাধা দিয়ে, ভয় দেখিয়ে তাকে টলানো যায় নি। নিজের বিশ্বাসে আর লক্ষ্যে অবিচল থেকে নিজের কাজ করে গেছেন। সমাজের উন্নতির পক্ষে ক্ষতিকারক প্রাচীন অবৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণাকে বিজ্ঞানের জ্ঞানের সাহায্যে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে গেছেন। বিজ্ঞানের অগ্রগতির কাজে সমাজের প্রভাবশালীদের অবৈজ্ঞানিক নিয়ন্ত্রণ, শাসনকে তিনি মেনে নেন নি। পৃথিবী কি করে সৃষ্টি হয়েছে বা মহাবিশ্বের নিয়মকানুন বিষয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষাই তাঁর কাছে একমাত্র পথচালিকা সত্য বলে বিবেচিত হয়েছে -এনিয়ে তার মধ্যে কোন অস্বচ্ছতা ছিল না ।

পৃথিবী স্থির, সূর্য তাকে কেন্দ্র করে ঘুরে চলেছে – এটাই সকলে দেখি খালি চোখে । তাঁর সময়ে বিগত ২০০০ বছর ধরে ধর্মযাজকরা এবং রাজা-মহারাজরাও সেই কথাটাই মানুষকে বলে এসেছেন । অতএব সেই সময়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত আইন ছিল এটাই যে, পৃথিবী হল স্থির। কিন্তু গ্যালিলিও তখন কোপার্নিকাসের প্রতিষ্ঠিত সত্যের সন্ধান পেয়ে গেছেন ও সেটাই বিজ্ঞা্নসম্মত বলে মেনে নিয়েছেন- সূর্য স্থির, পৃথিবী তার চারপাশে ঘুরে চলেছে । পৃথিবীকেন্দ্রিক সৌরজগতের ধারণার প্রবর্তক টলেমি ও তার পূর্ববর্তী জ্যোর্তিবিদ হিপাকার্সের জ্যোর্তিবিজ্ঞানের অগ্রগতিতে অনেক অবদান আছে। এটা মেনে নিলেও টলেমির পৃথিবীকেন্দ্রিক সৌরজগতের ধারনার সংশোধন করেন কোপার্নিকাস। তাঁর এই নতুন ধারণা তিনি তাঁর বই “অন দ্য রেভলিউশনস অফ দ্য হেভেনলি স্ফেয়ারস” এ ব্যাখা করেন । কোপার্নিকাসের মতবাদের পক্ষে থাকায় পুড়িয়ে মারা হয়েছে জিওর্দানো ব্রুনোকে -এটা জেনেও গ্যালিলিও সত্য প্রতিষ্টায় অবিচল ছিলেন । তাই তিনি মেনে নিয়েছিলেন ব্রুনোর “প্লুর‍্যালিটি অফ ওয়ার্ল্ড” তত্ত্ব।

কোপার্নিকাস বলেছিলেন “বাইবেল ধর্মের কথা বলে, বিজ্ঞানের কথা বলে না। …কোনো ধর্মপুস্তকের কিছু কথা নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করে কেউ যদি আমার ভাবনাকে আক্রমণ করে, আমি গ্রাহ্য করব না”। স্বাভাবিকভাবেই কোপার্নিকাসের মতবাদের সমর্থকদেরকে শাসক ও তার সহযোগী শক্তির মেনে নেবার কথা নয় । তারা মেনে নেয়ও নি । নানাভাবে গ্যালিলিওর উপরে প্রবল চাপ তৈরি শুরু করেছিল। এই সময়ে আর একটি ঘটনায় আগুনে ঘি পড়ল। তিনি দূরবীনের সাহায্যে গ্রহ-নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে দেখলেন চাঁদের ভিতরে উঁচু উঁচু পাহাড়, গর্ত, পাথর আর ছায়াপথের তারার সমাবেশ। বৃহস্পতির চারটে উপগ্রহ আবিষ্কার করলেন। নিজে দেখেই থেমে থাকলেন না, দেখাতে থাকলেন অনেককে ।

এই ঘটনায় বিজ্ঞানী মহলে ও সাধারণ মানুষের মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। শাসক এটাকে ভালোভাবে নিল না। তারা প্রচার শুরু করল – গ্যালিলিও ধর্মবিদ্বেষ প্রচার করছেন, বাইবেলের উপরে মানুষের বিশ্বাস নষ্ট করছেন । ১৬১৫ সালে পোপ তাকে ডেকে পাঠিয়ে সাবধান করেন ও এই ধরনের কাজ থেকে তাকে বিরত থাকতে বলেন । এরপরে তাকে একপ্রকার ঘর বন্দী্ থাকতে বাধ্য করা হয়। তবু তিনি শাসকের বা ধর্মগুরুর দাবি মেনে চাঁদ ও সূর্যকে ঈশ্বর বলে প্রচার করতে রাজি হন নি, বরং চাঁদ ও সূর্যকে বস্তুপিন্ডরূপে আখ্যা দেন। এই ভয়ংকর চাপের মুখেও তিনি নতিস্বীকার করেন নি।

তিনি ঘর বন্দী্ জীবনে হতাশায় নিজেকে ডুবিয়ে না দিয়ে ঘরে বসে থাকা জীবনকে ইতিবাচক ভাবে ব্যবহার করে লিখে ফেলেন “ডায়লগ অন দি টলেমিক অ্যান্ড কোপারনিকান সিস্টেমস” বই । এর মধ্যে নতুন পোপ তাকে ডেকে তাকে তার বক্ত্যব্যের সমর্থনে যুক্তি পেশ করতে আদেশ দেন । যদিও এতে কোন লাভ হয় না । বিচার হয় তার। গ্যালিলিওর বক্তব্য ‘অযৌক্তিক ও ধর্মমতের পরিপন্থী’ বলে রায় হয়। বিচারের রায়ের ব্যাখ্যায় বলা হয়, বাইবেলের সঙ্গে ও ধার্মিক যাজকদের মতের সাথে গ্যালিলিওর মতের মিল নেই, তাই তার মত গ্রহণীয় নয় । ঘর বন্দী জীবনে তিনি আর একটি বই “ডায়লগ কনসার্নিং টু দি প্রিন্সিপাল অফ দি ওয়ার্ল্ড” লিখে ফেলেন। এতে শাসকের রোষ আরো বেড়ে যায়। আবার বিচারসভা বসে। বিচারসভাতে তাকে শাসকের পছন্দ মত কথা বলতে বাধ্য করা হয়। বাইরের জগতে আসা একেবারে বন্ধ করে দিয়ে তাকে আবার তার বাড়িতে নজরবন্দী জীবনে ঠেলে দেওয়া হয়।

এই সময়ে তিনি তাঁর সূর্য কেন্দ্রিক বিশ্বের ধারণা্কে প্রকাশ করলেন “ডায়লগ কন্সার্নিং টু চিফ সিস্টেমস অফ ওয়ালর্ডঃ দি টলেমিক এন্ড দি কোপারনিকান” বই এর মাধ্যমে। এছাড়াও লিখে ফেলেন “ডায়লগ কনসার্নিং টু নিউ সায়েন্সেস” বই ও তা গোপনে ছাপার ব্যবস্থা করেন । সব যুগেই শাসকের মতের বাজনদার না হলে কারাগারে পাঠিয়ে শাসনযন্ত্রের ক্ষমতা প্রদর্শনের ঘটনা দেখা গেছে । কিন্তু কোন যুগেই কোন শাসক সত্যের প্রকাশকে আটকে রাখতে পারেন নি। তাই ঘরের অন্ধকারে শেষ জীবন কাটাতে বাধ্য হলেও বিজ্ঞানমনষ্কতার ব্যাটনকে পরের প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়ে যান ব্রুনো, গ্যালিলিওরা ।

লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!