খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ বৈশাখ, ১৪৩১ | ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Breaking News

  চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নতুন সভাপতি মিশা, সাধারণ সম্পাদক ডিপজল

নিয়তি

তাপস মন্ডল

ছেলেটার নাম বিনু। হয়তো জন্মের সময় মা বাবা শখ করে নামটা বিনোদ রেখেছিল। কিন্তু সে নাম তাদের হারিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে এখন এতটুক অবধি বেঁচে আছে। হারু মেম্বরের গোয়ালঘরের পাশেই ঘুপচিমত কাঠের ঘরটাতেই তক্তাপোশ বিছিয়ে আরামে রাতগুলো কাটিয়ে দিচ্ছে সে। সেদিক থেকে, হারু মেম্বার দিলদরিয়া লোক। এক অনাথ ছেলেকে এতদিন অযথাই পুষে রাখার কোন মানে হয় না, শুধু খরচ। তার উপর ছেলেটা খোঁড়া, ঠিকঠাক মত চলতেই পারে না। ওকে দিয়ে হাল চাষ কি করে হবে। নিতান্তই ঘরের আশপাশে দু চারটে বেড়াল আসলেই সে ওগুলো তাড়াতে পারে। এর বেশী কিছু নয়। কিন্তু হারু মেম্বার ওকে পড়ার উৎসাহ দেয়। স্কুলেও দিয়েছিল একবার কিন্তু সে টেকে নি। বলে, পড়ালেখা তাকে টানে না। হারু মেম্বার জিজ্ঞেস করে, তাহলে খাবি কি বড় হয়ে?

নিরুত্তর থাকে বিনু, যেন তার খাওয়া পরার কোন চিন্তা ইহজন্মে হবে না।

গ্রামের নাম ওড়াবুনিয়া। চোখ খুললেই সামনে পড়ে একটা মরা খাল। দুর্গন্ধের রাজত্ব সেখানে। গ্রামের যত মরা পঁচা আবর্জনা সব ফেলা হয় এখানে। জল সরবরাহেরও ঠিকঠাক কোন ব্যবস্হা নেই। বর্ষার মৌসুমে গ্রামটা যা একটু সুন্দর হয়ে ওঠে, বাকি সময়টা কাকের কালো চোখের মত ময়লা জল থাকে। অগভীর খালের পাশ দিয়ে অজস্র গাছের সারি। খালের একপ্রান্তে গেওয়া গাছের ছোট্ট একটা ডালে বসে থাকে ছোট্ট বিনু। দু একটা মাছরাঙা উড়ে এসে খালে মুখ দিয়ে পুঁটিমাছ ঠোঁটে করে উড়ে যায়। বিনু মুগ্ধ হয়ে মাছরাঙার শিকার দেখে। সে ও মনে মনে শিকারী হতে চায়।

ছোটবেলা থেকে বিনু বাবা মা কে দেখে নি। বাবা মার প্রসঙ্গ উঠলেই ওর চোখ ছলছল করে উঠত।কেন উঠত? তা সে জানে না।হারু মেম্বারকে সে একদিন বলল, আমার বাবা মা কোথায় জানো? হারু মেম্বার সংক্ষিপ্ত হাসি মুখে টেনে এনে বলল, ওরা পাটকলে কাজ করতে গেছে।
-কবে ফিরবে?
-এই ধর, ঐ পশ্চিমের আকাশটা যেদিন কালো হয়ে যাবে সেদিন ওরা ফিরে আসবে।

বিনুর চোখ আশায় চকচক করে উঠল। সে ও তার বাবা মা দেখতে পারবে। ও জানে না বাবা মা দেখতে কেমন হয়, তাদের ছুঁতে কেমন লাগে, মার কোলে শুয়ে পড়লে কতটা ক্লান্তি কমে যায়-কোনটাই জানে না সে। সে প্রত্যেকদিন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রচন্ড রকম আশা আকাঙ্খা নিয়ে আকাশকে বলে, তুমি আজকে কালো হলে আমার বাবা মা ফিরে আসবে।

পুবের সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ে। আকাশ লাল হয়। কিন্তু বিনু কখনো আকাশকে কালো হতে দেখে না। রাত হয়, আকাশের বুকে তখনো মিটমিট করে তারা উঁকি দেয়। বিনু ছোট্ট ঘরের ছিদ্র দিয়ে আকাশ দেখে আনমনে, জল গড়িয়ে পড়ে চোখ থেকে। তারপর কখন ঘুমিয়ে যায় সে জানতেও পারে না। ঘুম ভাঙে পাশের গোয়ালের গরুর হাম্বা হাম্বা চিৎকারে। ক্ষিদের জ্বালায় তোলপাড় শুরু করেছে সব। বিনু মুখ গুঁজে শুয়ে থাকে বালিশে। আজ তার উঠতে ইচ্ছে করছে না।

হারু মেম্বার নিঃসন্তান ছিলেন। এত অজস্র সম্পত্তি অথচ জ্ঞাতি, খুড়োর মধ্যে কাউকেই দিতে পারে এমন কেউ নেই। সবাইকেই লোভী মনে হয় হারু মেম্বারের। সন্তান প্রসবের সময় বউ আর মেয়েটা মারা গেলে তিনি আর বিয়ে করেন নি। কোন খারাপ সংসর্গেও তিনি যেতেন না। কিন্তু খুব বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন আগামীর জন্য। বিনুকে হারু মেম্বার সত্যিই ভালবাসতেন। বিনুকে কাছে ডেকে একদিন বললেন, আমাকে বাবা বলতে পারিস?

বিনু মিথ্যা বলত না। সে না বলে বসে রইল। তারপর বলল, আকাশ কালো হলেই আমার বাবা আসবে। আমি তোমাকে বাবা বলব কেন?

হারু মেম্বার কষ্ট পেয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু এই নির্লোভ ভালবাসা তাকে ছেলেটার জন্য আরো ভালবাসা বাড়িয়ে দিল বহুগুনে।

বিনু এখন ছাদে উঠতে পারে। ঘুপচি ঘর ছেড়ে সে এখন হারু মেম্বারের পাশের সুন্দর একটা ঘর পেয়েছে। নরম বিছানায় শুয়ে সে এখন পিছনের ফুলের বাগান দেখে, আকাশ দেখতে পারে না। সে ছাদে উঠে আকাশ দেখে। এর মধ্যে বর্ষাকাল এল হুড়মুড়িয়ে। আকাশ এখন প্রায়ই অন্ধকার হয়। কিন্তু পশ্চিমের আকাশে কোথাও যেন অন্ধকারটা কম থাকে। সেদিন গ্রামে পাটকলে কাজ করতে যাওয়া একদল মানুষ ফিরে এসেছে, তখন ঝুমঝুম করে বৃষ্টি হচ্ছিল। বিনু ভাবল, এই তো ওরা ঘরে ঢুকল বলে। কিন্তু কেউ আসল না। হারু মেম্বার স্বান্তনা দিয়ে বললেন, “পশ্চিমের আকাশ পুরোটা কালো না হলে তো বাবা মা আসবে না, তখনই তো ওদের ছুটি।’’ বিনু চুপ করে রইল। উত্তরটা শুনে সে যেন সন্তুষ্ট হয় নি এমন ভাব করে বসে রইল।

আষাঢ়ের এক বিকাল। হুট করে একগাদা কালো মেঘ পশ্চিমের আকাশকে অন্ধকারে ঢেকে দিল। হারু লাফাতে লাফাতে ছাদে উঠে দেখল পশ্চিমের অন্ধকার আকাশকে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে একের পর এক। হারু মেম্বার জোরে জোরে ডাকছে নিচ থেকে। বিনু বললো, আজ বাবা মা ফিরছে। সে ছাদ থেকে নেমে এল। দরজার দিকে চোখ তার। হারু মেম্বার বুকে হাত চেপে বসে পড়লেন। বিনুর সেদিকে খেয়াল হল না। হারু মেম্বার বললেন, “ওরে বিনু, শেষবেলায় ও কি বাবা বলে একটু ডাকবি নে?”

বিনু দাঁড়িয়ে রইল স্তম্ভিতের ন্যায়। এক শক্তসমর্থ শরীর মাটিতে গড়িয়ে পড়ার আওয়াজ ও মিলিয়ে গেল বিদ্যুৎ চমকানির শব্দে।

 

খুলনা গেজেট/এমএইচবি

 




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!