খুলনা, বাংলাদেশ | ১৫ চৈত্র, ১৪৩০ | ২৯ মার্চ, ২০২৪

Breaking News

  দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে খাদে পড়ে বাসে আগুন, নিহত ৪৫
  গাজীপুরের কাপাসিয়ায় গরু চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত ২

নিজের (নাফস’র) সাথে মুসলিম বান্দার আদবসমূহ (পর্ব : ০৬)

মাওলানা জুবায়ের হাসান

মুসলিম ব্যক্তি বিশ্বাস করে যে, তার দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জীবনের সফলতা নির্ভর করে তার ‘নাফস’ তথা স্বীয় অন্তরকে সংশোধন, পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করার পরিধির ওপর; যেমনিভাবে তার জীবনের ব্যর্থতা নিশ্চিত হয় তার মনের ভ্রষ্টতা, নিষ্ক্রিয়তা, কলুষতা, অবিত্রতা ও অশুদ্ধতার কারণে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَا، وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسَّاهَا
সে-ই সফলকাম হয়েছে, যে নিজেকে পবিত্র করেছে। আর সে-ই ব্যর্থ হয়েছে, যে নিজেকে কলুষিত করেছে। -সূরা আশ-শামছ, আয়াত: ৯ – ১০

রসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
كلُّ أُمَّتِي يَدْخُلُونَ الجَنَّةَ إِلَّا مَنْ أَبَى، قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ، وَمَنْ يَأْبَى؟ قَالَ: مَنْ أَطَاعَنِي دَخَلَ الجَنَّةَ ، وَمَنْ عَصَانِي فَقَدْ أَبَى
আমার সকল উম্মতই জান্নাতে প্রবেশ করবে, কিন্তু যে অস্বীকার করে, সে ব্যতীত; তারা প্রশ্ন করল: হে আল্লাহ রাসূল! কে অস্বীকারকারী? জবাবে তিনি বললেন: যে আমার অনুসরণ করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে; আর যে আমার অবাধ্য হবে, সেই মূলত অস্বীকারকারী। -সহীহ বুখারী, হাদিস নং- ৭২৮০

অনুরূপভাবে মুসলিম ব্যক্তি এটাও বিশ্বাস করে যে, যার উপর ভিত্তি করে আত্মা পবিত্র ও পরিশুদ্ধ হবে, তা হলো ঈমানের সৌন্দর্য ও নেক আমল; আর যার কারণে আত্মা কলুষিত, অপবিত্র ও ধ্বংস হবে, তা হলো কুফরী, অবাধ্যতা ও বদ আমল;

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
كَلَّا بَلْ رَانَ عَلَى قُلُوبِهِمْ مَا كَانُوا يَكْسِبُونَ
বরং তারা যা অর্জন করেছে, তা-ই তাদের অন্তরে মরিচা ধরিয়েছে। -সূরা আল-মুতাফ্ফিফীন, আয়াত: ১৪

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
إِنَّ العَبْدَ إِذَا أَخْطَأَ خَطِيئَةً نُكِتَتْ فِي قَلْبِهِ نُكْتَةٌ سَوْدَاءُ، فَإِذَا هُوَ نَزَعَ وَاسْتَغْفَرَ وَتَابَ سُقِلَ قَلْبُهُ، وَإِنْ عَادَ زِيدَ فِيهَا حَتَّى تَعْلُوَ قَلْبَهُ
নিশ্চয় মুমিন বান্দা যখন একটি গুনাহ করে, তখন তার অন্তরের মধ্যে তা একটি কালো দাগ সৃষ্টি করে; তারপর যদি সে তাওবা করে, গুনাহ থেকে দূরে থাকে এবং অনুতপ্ত হয়, তাহলে তার অন্তরকে চকচকে পরিষ্কার করে দেয়া হয়; আর যদি গুনাহর সংখ্যা বাড়তে থাকে, তাহলে (অন্তরের মধ্যে) কালো দাগের সংখ্যাও বাড়তে থাকে, এমনকি শেষ পর্যন্ত তা তার অন্তরকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেলে। -জামে তিরমিযী হাদিস নং- ৩৩৩৪

আর এটাই হলো অন্তরে মরিচা বা জঙ ধরা, যা আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: কখনো নয়; বরং তারা যা অর্জন করেছে তা-ই তাদের অন্তরে জঙ ধরিয়েছে।

তিনি আরও বলেন: তুমি যেখানেই থাক, আল্লাহকে ভয় কর; আর অসৎকাজ করলে তার পরপরই সৎকাজ কর, তাহলে তা মন্দ কাজকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে; আর মানুষের সাথে সদ্ব্যবহার কর।

এজন্য মুসলিম ব্যক্তি সার্বক্ষণিক কাজ করবে তার ‘নাফস’ তথা আত্মার সংশোধন, পরিশুদ্ধকরণ ও পবিত্রকরণে জন্য; কারণ, ঐ ব্যক্তির আত্মাই উত্তম, যে আদব রক্ষা করে চলে; সুতরাং সে তার নাফসের জন্য এমন কতগুলো আদব রক্ষা করবে, যা তার আত্মাকে পরিশুদ্ধ করবে এবং তার ময়লাসমূহকে দূর করে তাকে পবিত্র করবে; অনুরূপভাবে তাকে দূরে রাখবে খারাপ আকিদা-বিশ্বাস এবং মন্দ কথা ও কাজের মত এমন সব বিষয় থেকে, যা তাকে কলুষিত ও নষ্ট করে দেয়; আর সে তার উন্নতির জন্য সবসময় চেষ্টা-সাধনা করবে এবং প্রতি মুহূর্তে আত্মসমালোচনা করবে; সে তাকে নেক কাজে পরিচালিত করবে এবং তাকে (আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের) আনুগত্য করতে বাধ্য করবে; ঠিক অনুরূপভাবে সে তাকে দূরে রাখবে যাতীয় খারাপ ও মন্দ থেকে; তাকে সংশোধন ও পরিমার্জনের জন্য নিম্নোক্ত পদক্ষেপসমূহের অনুসরণ করবে:

(ক) তাওবা: তাওবার উদ্দেশ্য হলো সকল প্রকার অপরাধ ও অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকা, পূর্বের কৃত প্রত্যেকটি গুনাহ’র জন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হওয়া এবং ভবিষ্যৎ জীবনে পুনরায় সেসব গুনাহ না করার ব্যাপারে দৃঢ় অঙ্গীকার করা। যখনই নিজের অজান্তে অপরাধ সংঘটিত হবে, সাথে সাথে ত্ববা করে নিবে।

(খ) মুরাকাবা: ‘মুরাকাবা’ হল চিন্তা ভাবনা। তথা মুসলিম ব্যক্তি কর্তৃক তার ‘নাফস’কে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তায়ালার পর্যবেক্ষণে নিয়ে যাওয়া এবং জীবনের প্রতিটি কাজের মুহূর্তে সে চিন্তা ভাবনা করবে যে, এই কাজ আমার সঠিক হচ্ছে নাকি বেঠিক? এই কাজের দ্বারা আমি আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য অর্জন করছি নাকি তার থেকে দূরে চলে যাচ্ছি। যদি তার কাছে মনে এটি গোনাহের কাজ! তাহলে সে তা থেকে বিরত থাকবে। আর যদি নেক কাজ হয়, তাহলে কর্ম সম্পাদন করবে।

(গ) মুহাসাবা: ‘মুহাসাবা’ হলো যখন মুসলিম ব্যক্তি এ জীবনে রাতদিন এমনভাবে আমল করে, যা তাকে পরকালে সৌভাগ্যবান করবে, আখিরাতে সম্মান ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনকে সম্ভব করে তুলবে এবং দুনিয়া হবে তার মৌসুম বা সময়কাল, তখন তার উচিত হলো প্রত্যেক দিনের শেষে নিরিবিলে নির্জনে একটি সময় বের করে তার সেদিনের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে আত্মসমালোচনা করবে; তারপর সে যদি দেখে আবশ্যকীয় বিধানসমূহ পালনে কোনো ঘাটতি বা ত্রুটি হয়েছে, তাহলে সে স্বীয় নাফসকে তিরস্কার করবে এবং তাৎক্ষণিকভাবে তা সংশোধন করার জন্য পদক্ষেপ নেবে।

সুতরাং তা যদি কাযা আদায় করার মত কোনো বিষয় হয়ে থাকে, তাহলে কাযা করে নেবে; আর কাযা আদায় করার মত বিষয় না হলে বেশি করে নফল আদায় করার মাধ্যমে তার ঘাটতি পূরণ করার চেষ্টা করবে। আর যদি সে নিষিদ্ধ কাজে জড়িত হওয়ার কারণে কোনো ক্ষতির বিষয় লক্ষ্য করে, তাহলে সে ক্ষমা প্রার্থনা করবে, অনুতপ্ত হবে, তাওবা করবে এবং এমন ভালো কাজ করবে, যাকে সে তার অন্যায়ের পরিপূরক মনে করবে।

(ঘ) মুজাহাদা: আর ‘মুজাহাদা’ হলো মুসলিম ব্যক্তি জেনে রাখবে যে, তার জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু হলো তার ‘নাফস’, যা স্বভাবতই খারাপ কাজের প্রতি আকৃষ্ট, ভালো কাজ থেকে পলায়নমান এবং মন্দ কাজের উস্কানিদাতা বা নির্দেশদাতা।

সুতরাং মুসলিম ব্যক্তি যখন এ বিষয়টি বুঝতে পারবে, তখন সে নিজেকে প্রস্তুত করবে তার ‘নাফস’কে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা ও সাধনা করার জন্য; ফলে সে তার বিরুদ্ধাচরণ করবে। ফলে তার ‘নাফস’ যখন শান্তি পছন্দ করবে, তখন সে তাকে তার সুযোগ করে দিবে। আর যখন লোভ লালসার প্রতি আগ্রহী হবে, তখন সে তার জন্য তা হারাম করে দিবে; আর যখন কোনো আনুগত্য বা ভালো কাজ করার ক্ষেত্রে ত্রুটি করবে বা বিরত থাকবে, তখন তাকে শাস্তি দিবে এবং তিরস্কার করবে, তারপর যে (ভালো) কাজটি করতে ব্যর্থ হয়েছে, তা করতে তাকে বাধ্য করবে এবং যা কাযা বা বর্জন করেছে, তার কাযা আদায় করতে বাধ্য করবে। সে তার জন্য এ পদ্ধতি অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাবে যতক্ষণ না তার মন প্রশান্তি লাভ করবে ও পবিত্রতা অনুভব করবে; আর এটাই আপন (নাফস)-এর জন্য চূড়ান্ত পর্যায়ের চেষ্টা ও সাধনা। আল্লাহ তা’আলা তাওফিক দান করুন।

(লেখক : ইমাম ও খতিব, কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়)

 

খুলনা গেজেট/এমএইচবি




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!