খুলনা, বাংলাদেশ | ১১ বৈশাখ, ১৪৩১ | ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

Breaking News

  নাটোরের সিংড়া উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি-সম্পাদককে দল থেকে অব্যাহতি
  আপিল বিভাগে ৩ বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি; গেজেট শিগগিরই

ঝুলন্তপাড়া : ‘জন্ম যেখানে আজন্ম পাপ’ (ভিডিও)

নিপা মোনালিসা

বাংলাদেশের দক্ষিণের শেষ জনপদ খুলনার দাকোপ উপজেলার কালাবগী ঝুলন্ত পাড়া। যেখানে জন্মই যেন আজন্ম পাপ। নিরন্তর সংগ্রামই যেখানে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। প্রাকৃতিক দূর্যোগ আর নদী ভাঙনের নির্মমতা, সামান্য পানিবৃদ্ধিসহ ঝড় তুফানে নির্ঘুম রাত কাটানো, দারিদ্রতা, খাবার পানির হাহাকার, ছোট্ট টংঘরে একসঙ্গে গাদাগাদি করে ৮-১০ জনের থাকা খাওয়া, কাদা-পানির রাস্তা, চিকিৎসার জন্য ৩০ কিঃ মিঃ দূরের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ছুটে চলা, পথিমধ্যে অনেকেরই মৃত্যু এটাই ঝুলন্তপাড়ার নৈমিত্তিক চিত্র। বাকি কিছু আশা করা এখানে বিলাসিতা।

দাকোপ উপজেলার সুতারখালী ইউনিয়নের ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড জুড়ে এই ঝুলন্তপাড়া। খুলনা সদর থেকে প্রায় ৫০ কিঃ মিঃ দূরে এলাকাটির অবস্থান। শিবসা নদীর চরে গড়ে তোলা অসংখ্য টংঘরে এ জনপদের বসবাস। এর পূর্বে ভদ্রা, পশ্চিমে শিবসা নদী আর ওপারে সুন্দরবন। এখানে প্রায় ৪শ’ পরিবারের বসবাস। প্রাকৃতিক দূর্যোগ আর নদী ভাঙনে কবলিত এ এলাকার মানুষের দূর্ভোগের কোন শেষ নেই। এখানে ভাল থাকা মানে তিনবেলা পেটভরে ভাত খাওয়া আর একটু নিশ্চিন্তে ঘুমানো।

সরেজমিনে ঝুলন্তপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, শিবসা নদীর চরে কাঁকড়া গাছের খুঁটি, শিরিষ কাঠের পাটাতন, গোলপাতার বেড়া ও ছাউনি দিয়ে তৈরি অসংখ্য টংঘর। ঘরের মধ্যেই রান্না, খাওয়া, থাকা সব একসঙ্গে। প্রতিটি ঘরের সাথেই রয়েছে ঝুলন্ত শৌচাগার। এসব ঘরে অনেকটা গাদাগাদি করেই থাকেন পাঁচ থেকে দশ সদস্যদের একেকটি পরিবার।

এলাকাটি ঘুরে দেখা যায়, ঘরের মধ্যে কেউ রান্না করছে, কেউ কাপড় ধুচ্ছে, কেউ গোসল করছে, কেউবা অলস বসে আছে। অনেকে নদীতে মাছ ধরার প্রস্তুতি স্বরুপ নৌকা মেরামতেও ব্যস্ত। এখানকার প্রতিটি ঘরের সাথেই বাধা সারি সারি নৌকা। জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস নদীতে মাছ ধরতে এই নৌকা নিয়েই বেরিয়ে পড়েন তারা। এছাড়া সুন্দরবন থেকে কাঠ, গোলপাতা, মধু ও কাঁকড়া সংগ্রহ করেও জীবন চলে তাদের।

সুন্দরবনের কোলঘেষে বসবাসরত এখানকার মানুষের ব্যতিক্রম এ জীবনধারা শুধুই যেন কষ্টেগাথা। শিবসা গিলে খেয়েছে এদের পৈতৃক ভিটামাটিসহ প্রাথমিক বিদ্যালয়, কবরস্থান, শ্মশানও। বছর দুয়েক আগে ৯নং ওয়ার্ডের ফকিরের কোনা নামক অংশটুকু বিচ্ছিন্ন হয়ে দ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে যাওয়া-আসার একমাত্র মাধ্যম নৌকা।

স্থানীয় সূত্রে আরও জানা যায়, এখানে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যেতেও সময় লাগে ঘন্টা দুয়েক। আর তাই প্রাথমিক থেকেই ঝরে পড়ার হার বেশি। এখানে বিদ্যালয়ের গন্ডি পেরোতে না পেরোতেই ছেলেরা বেছে নেয় উপার্জনের পথ। আর মেয়েরা অধিকাংশই বাল্যবিয়ের শিকার হয়।

এলাকার পয়ষট্টি বছর বয়সী সবুর খান বলেন, ‘ঝুলন্তপাড়া তো আগে ছেল না। নদীতি যহন সব ভাইঙ্গে গেচে তহন কেউ যাইত পারল না কোন জাগায় সেইভাবে আমরা এইখানে বসবাস করতিচি। কত্ত পরিবার এইখান থেইকে চইলে গেছে। আমাগে জাগাজমি নেই তাই এইখানে পড়ে আচি। কাদাপানি ভাঙ্গে যাতায়াত করতি হয়। সারা বছর বৃষ্টির পানি ধইরে রাখতি হয় খাওয়ার জন্যি। তারপর যখন না মিলেন যাই তখন বিভিন্ন জায়গায় পুকুর আছে সিখান থেকে কিনি খাইতি হয়। দুর্ভোগের কতা কইয়ে কি করব! কেউ তো আর কুমাতি পারবে না।’

তিন মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে এখানেই ছোট্ট একটি ঘরে বাস করেন ফাহিমা বেগম। তিনি বলেন, ‘এই ঘরে আর বারান্দায় কষ্ট করে থাকতি হয় কি করব! এর আগে ওই ভাঙনের মাথায় ছিলাম, সব ভাঙ্গেচুরে নদীতি চইলি গেচে, কিচ্চু নেই সেনে। ছেলে আর ওর বাপ দুইজনই পাগল। আমি আর আমার বড় মায়েডা একটু জাল টানি তাতে কোনরকমে সংসারডা চলতেচে। সব কাম নেই, এই তাই এক অক্ত খালি দুই অক্ত ওমনি থাহি।’

মোঃ খোকন সরদার (৭০) আক্ষেপ করে বলেন ‘কষ্টের কি কোন শেষ আছে! কাজ কাম নাই, নদীতে মাছ ধরতি পারি না, অনেক টাকা ঋণ হয়ে গেচে। যখন ঝড়বৃষ্টি হয় তখন তো এইখানে থাহাও যায় না। গণের সময় জোয়ারের পানি উঠে যায়। যখন পানি বৃদ্ধি হয় তখন জঙ্গল থেকে সাপ আসে, হরিণ, কুমির, বাঘও আসে। সরকার যদি আমাগে বসবাসের জন্যি একটু খাস জমির ব্যবস্থা করতো তাইলি আমরা একটু বাঁচতাম।’

রেবেকা বেগম (৪৫) বলেন, ‘ছেলেমেয়ে গুলোনরে লেখাপড়াও করাতি পারিনি। তা আমি কি করি লেখাপড়া শিখোবো কও! আমার ওই ছাউয়ালের যা মাথার ব্রেইন, এত সুন্দুর, তা খালি গরিবির জন্যি আইজকের ওই ছাউয়াল জাল ধরে। ছোট মেয়েরে বিয়ি দিচি ১৩ বছরে আর বড় মেয়েরে দিচি ১২ বছরে। আমার আশা ছেল ম্যাট্টিক পর্যন্ত পড়াবো তা সে আশাডা আল্লাহ দেলে না। আইলা আম্ফানের কতা মনে পড়লি এহনই চোহি পানি আসে।’

মোঃ জসিম (২২) বলেন, ‘ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়িচি। আয় নেই আমি পড়ালেখা করলি সংসার চলে না। তাই বাধ্য হয়েই সেই ছোটকাল ধরে এইখানে মাছ ধরি। কোনদিন এক হাজার টাকা হয় কোনদিন মোটে হয় না। আবার এক দুই মাস বইসে থাকতি হয়। বাইরে যায়ে কাজ করে ওই টাকায় আমাগে চলে না। যখন সিগনাল ওঠে তখন এই ঘরদরজা জিনিসপত্র সব ফেলে রেখে সাইক্লোনে চলে যাই। এইখানে নিকট একটা সাইক্লোনও নাই। যাতি হয় সেই ২/৩ কিলো দূরে।

মোঃ খোকন সানা (৩৫) বলেন, ‘আমার দশ কাঠা জমির ওপর বাড়ি ছিল, সেখানে পুকুর কাটা ছিল, ভাল পরিবেশ ছিল। বছর দুই হচ্ছে নদী ভাঙনে তা বিলীন হয়ে গেছে। নদীতে মাছ ধরেই আমাদের সংসার চলে। অনেক সময় মাছ ধরা বন্ধ থাকলে আমাগে খুব কষ্টে দিন কাটাতি হয়। নদীতে মাছ ধরতে যেয়ে অনেককে বাঘে খাইছে, কুমিরে নিয়ে গেছে। আমাগে জীবন এভাবেই চলে।’

সুতারখালী ইউনিয়নের ৯নং কালাবগী ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নিমাই কুমার রায় বলেন, ‘এখানকার মানুষের যে মৌলিক চাহিদা এর কোনটাই নেই। এখানকার মানুষ সুপেয় পানি পায় না, স্যানিটেশনের ব্যবস্থা নেই, সুচিকিৎসারও ব্যবস্থা নাই। খুব দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে হয় আমাদের। এখানকার ঘরবাড়ি, জমিজমা সব বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এখানে বাঁধেরও কোন ব্যবস্থা নেই।’

তিনি বলেন, ‘এই ওয়ার্ডে প্রায় ৩৪০ পরিবার এদের আয়ের তেমন কোন উৎস নাই। এখানকার বাচ্চারা ঠিকমত লেখাপড়া করতে পারে না, স্কুলে যেতে পারে না। চিকিৎসার জন্য ৩০ কিঃমিঃ দূরে চিকিৎসাকেন্দ্রে ট্রলারযোগে নিতে নিতে পথিমধ্যে অনেকের মৃত্যুও হয়। কিছুদিন আগে এক গর্ভবতী মাকে ট্রলারে নিয়ে যাওয়ার পথেই তিনি মারা যান।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখানে যদি ছোটখাট একটা কমিউনিটি ক্লিনিক করা হয় তাহলে আমরা একটু চিকিৎসার ব্যবস্থা পাব। ইউনিয়ন পরিষদে এ ব্যাপারে কথা হয়েছে। পাশাপাশি যদি একটা বাঁধের ব্যবস্থা হয় তাহলে এখানকার অনেকে জমিজমা কিছুটা ফিরে পাবে, আয়ের উৎসও বের হবে। সরকার বা এনজিও’র কাছ থেকে যে সহযোগিতাগুলো আমরা পাই তা খুবই সীমিত।’ তিনি সরকারের নিকট এই জনপদটির জীবনমান উন্নয়ন ও পুনর্বাসনের জোর দাবি জানান।

সুতারখালী ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ মাসুম আলী ফকির বলেন, ‘ঝুলন্তপাড়া থেকে ওদেরকে স্থানান্তরের ব্যাপারে অনেকবার আমরা প্রশাসনের সাথে কথা বলেছি। কিন্তু এখনও কোন সুরাহা করতে পারিনি। যেটুকু সহযোগিতা আসে সেটাও ওদের জন্য পর্যাপ্ত না।’

উল্লেখ্য, ১৯৮৮ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পর এই এলাকায় ঝুলন্ত ঘর তৈরি শুরু হয়। তারপর থেকে এর নাম হয় ঝুলন্তপাড়া। কয়েক দফা নদীভাঙনে বসতি ও জমি চলে গেছে শিবসা নদীতে। সিডর ও আইলার আঘাতে বসতভিটা আর রাস্তা ভেঙে যাওয়ায় পাড়াটির পরিধি আরও বেড়েছে। এদিকে সরকার নদী থেকে পোনা আহরণ নিষিদ্ধ করায় এবং বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকায় জীবিকার তাগিদে অনেকেই পরিবার নিয়ে এলাকা ছেড়েছেন।

খুলনা গেজেট/এমএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!