খুলনা, বাংলাদেশ | ১১ বৈশাখ, ১৪৩১ | ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

Breaking News

  চাঁদপুরের হবিগঞ্জে ট্রেনে কাটা পড়ে মা ও শিশুর মৃত্যু
  নাটোরের সিংড়া উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি-সম্পাদককে দল থেকে অব্যাহতি

জাতিসংঘ মিশনে সাফল্য, আনন্দ ও কষ্ট

এ এম কামরুল ইসলাম

মালয়শিয়ান মি. মুনানদাই তাঁর বাসায় নিয়ে আমাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাঁরা মালয়শিয়ান হলেও কারো নাম শুনে মুসলমান মনে হলো না। তাতে আমার কোন সমস্যা ছিল না। তবে রাতে খাবার টেবিলে বসে সমস্যায় পড়ে গেলাম। তাঁদের মেনুতে সেদিন শুকরের মাংস ছিল। মি. মুনানদাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন Do you like pork?

আমি সাথে সাথে বললাম No, thanks.

অবশ্য আমি কোন প্রকার অভক্তি প্রকাশ না করেই শুধুমাত্র সবজি দিয়ে খেয়ে তৃপ্তি প্রকাশ করলাম। তাঁদের আন্তরিক আতিথেয়তায় আমি খুশি হয়েছিলাম।

সকালে ঘুম থেকে উঠে সবার আগে ভোর পাঁচটার আগে আমি একা ডিউটি স্থলে গিয়ে হাজির হলাম। অন্যান্যরা এলেন ছয়টার পর। ঐ দিন ডিউটি ছিল ভোটার তালিকা তৈরীতে নির্বাচন অফিসারদের সহায়তা করা। কিন্তু নির্বাচন অফিসারবৃন্দ এলেন সবার পরে।

সকালে নাস্তা না খেয়ে আমার পেট ক্ষুধায় জ্বলতে লাগলো, তবুও নতি স্বীকার না করে দুপুর পর্যন্ত ডিউটি করে তারপর দুপুরের খাবারের বিরতির সময় সবাই যার যার মতো খেতে গেলাম। অন্যেরা যার যার বাসায় খেতে গেলেও আমি গেলাম হোটেলে। খাবার খেয়ে আবার সবার আগে ডিউটিতে পৌঁছে গেলাম। বিকাল পাঁচটায় ডিউটি শেষ করে একটা হোটেলে সীট নিলাম। আমার সাথে শুধুমাত্র এক সেট পোশাক ছাড়া অন্য কোন কাপড় ছিল না। কারণ জেলা থেকে আসার সময় কে জানতো এমন আকস্মিকভাবে এতসব ঘটনা ঘটে যাবে। আমিও মনে মনে ঠিক করলাম- আমি কোনমতে হার মানবো না। যত কষ্ট হোক, আমি বাংলাদেশকে আর ছোট ভাবার সুযোগ দেবো না। আমরা সকল বাংলাদেশি ড্রাইভিং পরীক্ষায় ফেল করায় সকল দেশের লোকজন আমাদেরকে অদক্ষ হিসেবে গণ্য করেছিল, এখন ডিউটিতে গাফিলতি পেলে আরো অদক্ষের খাতায় ফেলে দেবে। সুতরাং আমাকে পারতেই হবে।

রাতে থাকার হোটেল ঠিক করে দ্রুত বাজারে গিয়ে একটি তোয়ালে ও একটি নাইট ড্রেস ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিসপত্র কিনে রাতের খাবার খেয়ে সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন আবারও ভোর পাঁচটায় ডিউটিতে যেতে হবে।

এভাবে পর পর তিন দিন এক কাপড়ে ডিউটি করার পর ও অনিয়মিত খাওয়ার কারণে আমার শরীরে জ্বর এসে গেল। তারপরও আমি উর্ধতন অফিসারের কাছে নতিস্বীকার না করে রীতিমতো ডিউটি করতে থাকলাম। একদিন বিকালে ডিউটি শেষে অফিসে গিয়ে ভাবলাম বসের কাছে অসুখের কথা বলি। এমন সময় দেখলাম নতুন তিনজন ইন্টারপ্রেটর যোগদান করেছেন। তারা সবাই ছিলেন কম্বোডিয়ান। তাদের মধ্যে একজন মেয়ে ও দুইজন ছেলে। আমি বসের সাথে দেখা করার আগেই তারা আমার সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য করমর্দন করলেন। প্রথমে ছেলে দুটো পরিচিত হলেন, তারপর মেয়েটি করমর্দন করতে গিয়ে বললেন, Oh my God! You are very sick. You need rest. Where do you live sir? May I help you to reach there?

আমি তাঁকে এড়িয়ে যাবার শত চেষ্টা করেও ছাড় পেলাম না। মেয়েটি আমাকে হোটেলে পৌঁছে দেবার জন্য জোরাজুরি শুরু করে দিলেন। এমনকি বস অফিসে এলে আমার অসুস্থতার কথা বুঝিয়ে বলবেন বলে জানালেন।

আমার নতুন কর্মস্থলের বস ছিলেন একজন মিশরীয় এডিশনাল এসপি। ইতিমধ্যে তিনি আমাকে বেশ পছন্দের তালিকায় নিয়ে আমার কাজকর্ম পর্যবেক্ষনে রেখেছিলেন। আমি যখন ঐ নাছোড়বান্দা মেয়েটির কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করছিলাম তখন বস অফিসে ছিলেন না। কতক্ষণ অপেক্ষা করলে বসকে আমার অসুস্থতার খবর দেওয়া যাবে তাও অনিশ্চিত ছিল। এক পর্যায়ে মেয়েটি আমাকে গাড়িতে উঠতে বাধ্য করলেন। আমার হোটেলের পরিবর্তে তার পিড়াপিড়িতে আমাকে ইন্ডিয়ান আর্মি হাসপাতালে যেতে হলো। সেখানে যাবার পর আমার অর্ধেক জ্বর এমনিতেই চলে গেল। কারণ সেখানে যে ডাক্তার আমাকে চিকিৎসা দিলেন তিনি ছিলেন ইন্ডিয়ান আর্মি মেডিকেল কোরের একজন কর্ণেল। তাঁর নেমপ্লেটে লেখা ছিল দাসগুপ্ত। আমি জ্বরের ঘোরে প্রথমে তার নাম লক্ষ করিনি। কর্ণেল সাহেবের কথাবার্তা শুনে আমার ভীষণ ভাল লাগলো। এক পর্যায়ে তিনি আমাকে বাংলাদেশি জেনে মারাত্মক আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়লেন এবং বাংলায় কথা বলতে শুরু করলেন। কর্ণেল দাসগুপ্ত মূলতঃ বাংলাদেশের বিক্রমপুরের মানুষ। বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের সময় তিনি খুলনা এলাকায় ইন্ডিয়ান আর্মির সাথে ছিলেন। এই দুই কারণে তিনি বাংলাদেশের প্রতি ভীষণ দূর্বল। তাছাড়া তাঁর হাসপাতালে তিনিই একমাত্র বাঙালি ছিলেন। আমাকে বাঙালি রুগী হিসেবে পেয়ে তাঁর চিকিৎসার আগ্রহ শতগুণ বেড়ে গেল। আমারও অসুখ অর্ধেক ভাল হয়ে গেল। পরবর্তীতে আমি যতদিন হেডকোয়ার্টারে ছিলাম ততদিন আমাদের দু’জনের মধ্যে আত্মার সম্পর্ক ছিল। কর্ণেল দাসগুপ্ত ও আমার মধ্যে সম্পর্কের কাহিনী বলতে গেলে আরো অনেক লিখতে হবে। পরবর্তী কোন অংশে হয়তো লিখবো।

হাসপাতাল থেকে ঔষধ নিয়ে আমার হোটেলের উদ্দেশ্য রওয়ানা করলাম। ইন্টারপ্রেটার মেয়েটি আমার গাড়িতে ছিলেন। তাঁকে অফিসে নামিয়ে দিয়ে তারপর আমি হোটেলে যাবো ভেবে অফিসের দিকে রওয়ানা হলাম। কিন্তু মেয়েটি কোনমতে আমাকে কষ্ট দিতে রাজি হলেন না। তাই তাঁর কঠিন অনুরোধে আমি হোটেলের দিকে রওয়ানা হলাম। মাঝপথে তিনি আমার জন্য কয়েক প্রকার ফলমূল কিনে গাড়িতে করে আমার হোটেল পর্যন্ত গিয়ে আমাকে রুমে ঢুকিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে তারপর অফিসে গেলেন।

আমি জ্বরের ধাক্কায় মেয়েটির দেওয়া কোন ফল স্পর্শ না করেই দরজা খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়লাম। রাত অনুমান নয়টার সময় ঘুম ভেঙে গেলে চোখ মেলে দেখলাম আমার মাথার কাছে সেই মেয়েটি ফল কেটে একটি প্লেটে নিয়ে বসে আছেন। আমি হতচকিত হয়ে তাঁর দিকে চেয়ে বললাম- When and how entered into my room?

মেয়েটি বললেন- I went to office to pick my bicycle and came back to see you.

-How do you entered my room and why? It is night time. How will you go back to your home?

-I entered your room with the help of the hotel authority. My residence is not far from here.

-I know that your society is very much conservative. So, anyone may mind it seriously.

-So what? You are here to serve my country and now you are sick. Nobody of your contingent is here to look after you. So I will be here till you will be cure.

মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আমি আকাশ পাতাল কল্পনা করতে লাগলাম। আমার দেশের কোন সদস্য থাকলেও হয়তো এভাবে আমার জন্য সহানুভূতি দেখাতো না। আমার শত নিষেধ অমান্য করে মেয়েটি আমাকে বিছানা থেকে উঠিয়ে হাতমুখ ধুইয়ে দিলেন। আমার পরনে তখনও পুলিশের পোশাক ছিল। আগেই বলেছি, আমি এক কাপড়ে জেলা থেকে হেডকোয়ার্টারে এসেছিলাম। সুতরাং কয়েকদিন যাবৎ বাধ্য হয়ে আমাকে এক কাপড়ে থাকতে হচ্ছিল। অবশ্য একটি তোয়ালে ও একটি আটপৌরে ড্রেস কিনলেও মেয়েটির সামনে তা পরিবর্তন করতে সংকোচ হচ্ছিল।

হাতমুখ ধোয়ার পর মেয়েটি জোর করে আমাকে তার কেনা ফলমূল খাওয়ালেন। আমি শুয়ে শুয়ে তাঁর আদেশ পালন করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়লাম তা বুঝতে পারিনি। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম আমার রুমের দরজা চাপানো কিন্তু খোলা। রাতে তাঁর অকৃত্রিম সেবায় আমার জ্বর কিছুটা কমলেও অফিসে যেতে মন চাচ্ছিল না। কিন্তু মনে মনে ভাবলাম- তিন/চার দিনের মধ্যেই অফিসে যেতে ব্যর্থ হলে আবার বাংলাদেশিদের সম্পর্কে বিরূপ ধারণা হবে এবং আমার চ্যালেণ্জে আমি হেরে যাবো। তাই হাতমুখ ধুয়ে পোশাক পরে অফিসের দিকে রওয়ানা হয়ে দেখলাম সেই মেয়েটি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন। আমি আরো একবার বিস্মিত হলাম। আমি গাড়ি থামিয়ে তাঁকে গাড়িতে উঠতে অনুরোধ করতেই তিনি প্রথমে আমার জ্বরের খবর নিয়ে বললেন- Thanks sir. I am coming by my bicycle.

অফিসে গিয়ে প্রথমে জেলা কমান্ডারের সাথে দেখা হতেই তিনি আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন- Congratulations. Provincial Commander confirmed your posting here. You may meet the Commander at once.

আমি আমার জ্বরের খবর তাঁকে না জানিয়েই Provincial commander এর কাছে গেলাম। তিনি আমাকে দেখেই বললেন Mr. Islam, I am highly pleased to your performance. Your district Commander also appreciated you. So, you may go to your old district to pick up your luggages and you can rent a house nearby. If you want to stay with your friends for one or two days, you can. I know, it will be difficult for you to stay here alone. But I am undone.

আমি আমার জ্বরের কথা তাঁকেও না জানিয়ে বরং বিশাল একটা ধন্যবাদ দিয়ে সোজা পুরনো জেলা ডেমডেকের উদ্দেশ্য রওয়ানা দিলাম।

ডেমডেক পৌঁছার পর সকলে আমার সাফল্যে সন্তোষ প্রকাশ করলেন। অনেকেই আমার পোস্টিং এর রহস্য জানতে উদগ্রীব ছিলেন। আমি সেখানে একদিন থেকে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লাগেজ গুছিয়ে পরদিন আবার নতুন কর্মস্থলে যোগ দিলাম।

আনন্দ

নিজের দেশের সম্মান রক্ষা করার আনন্দ ও নিজের দক্ষতা প্রমাণ করার সুখ কিছুটা হলেও অনুভব করলাম।

বিদেশের মাটিতে বাংলায় কথা বলার মতো একজন ভাল মানুষের সন্ধান পেলাম। তিনি হলেন কর্ণেল দাসগুপ্ত।

আমার অসুস্থতার সময় একজন বিদেশি মেয়ের সেবা আমাকে আজো আনন্দ দেয়। ঐ প্রদেশে থাকা অব্দি তিনি আমাকে ছায়ার মতো আগলে রেখেছিলেন।

কম্বোডিয়া মিশনে প্রথম কোন বিদেশিদের বাসায় রাত্রি যাপনের অভিজ্ঞতা হলো।

বেদনা

এই পর্বে শুধুমাত্র ডিউটিতে কয়েকদিন কষ্ট হলেও বেদনার কিছুই ছিল না। চলবে…

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার। (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, অব.)

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!