খুলনা, বাংলাদেশ | ১১ বৈশাখ, ১৪৩১ | ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

Breaking News

  রাঙ্গামাটির সাজেকের উদয়পুর সড়কে ট্রাক খাদে পড়ে ৬ শ্রমিক নিহত
  চাঁদপুরের হবিগঞ্জে ট্রেনে কাটা পড়ে মা ও শিশুর মৃত্যু
  নাটোরের সিংড়া উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি-সম্পাদককে দল থেকে অব্যাহতি

ছাত্রলীগের বড় অর্জন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ

কাজী মোতাহার রহমান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত ১৯৭১ সালের ২ মার্চ অনুষ্ঠানে প্রথম পতাকা উত্তোলন করেন ডাকসুর সহ সভাপতি আ স ম আব্দুর রব।

পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলের চুয়াত্তর বছরের রাজনীতিতে সৌরভের-গৌরভের বড় দাবিদার ছাত্রলীগ। শত ঐতিহ্যের পাশাপাশি দুর্নামের দুর্গন্ধ বহন করতে হয়েছে শেষ দু’যুগে। এ ছাত্র সংগঠনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে সামরিক শাসন বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে। ছাত্রলীগের আত্মপ্রকাশের পর উল্লেখযোগ্য অধ্যায় ১৯৪৮-১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টকে সমর্থন দান, ১৯৬২ সালে শরীফ কমিশন রিপোর্ট বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনকে সমর্থন দান, ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানের লৌহমানব প্রেসিডেন্ট জেঃ আইয়ুব শাহীর পতন, আগরতলা মামলা প্রত্যাহারে গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ, ১৯৭৫-৭৮ জেঃ জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন বিরোধী এবং ১৯৮২-৯০ পর্যন্ত জেঃ এইচ. এম. এরশাদের সামরিক শাসন বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অধ্যায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। আর সেটাই ছাত্রলীগের বড় অর্জন।

১৯৬৯ সালে আগরতলা মামলা প্রত্যাহার, ১৯৭০ সালের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন এবং ৭১’র মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের সর্বস্তরের কর্মীর অংশগ্রহণ ছিল লক্ষণীয়। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার রূপরেখা, জাতীয় সংগীত নির্বাচন, স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন, স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, ৭মার্চের জনসভা সফল, জয় বাংলা বাহিনী গঠন, ৭১’র ২৩ মার্চ বাংলাদেশ দিবস পালন এবং মুজিববাহিনী গঠন ছাত্রলীগের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।

১৯৭১ সালের ৩ মার্চ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের শপথ গ্রহণ।

ছাত্রলীগের গর্ভে “জয় বাংলা” শ্লোগানের জন্ম। এ ছাত্র সংগঠনের সৃষ্টি “তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা”, “বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর”, “তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব” নামক শ্লোগান। ছাত্রলীগই বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করে।

১৯৬৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর মহান শিক্ষা দিবস উপলক্ষে ঢাবিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আলোচনা সভায় প্রথম “জয় বাংলা” শ্লোগানটি উচ্চারিত হয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা আফতাব উদ্দীন আহমেদ (পরবর্তীতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য) ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহ-সম্পাদক চিশতী শাহ হেলালুর রহমান (পরবর্তীতে সংবাদ কর্মী ও একাত্তরে শহীদ) সেদিন তাদের কন্ঠে শ্লোগানটি উচ্চারিত হয়। ১৯৭০ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের উপস্থিতিতে দ্বিতীয় বারের মত এ শ্লোগানটি উচ্চারিত হয়। একই বছরের ১৮ জানুয়ারি পল্টনে আওয়ামী লীগের জনসভায় বঙ্গবন্ধু এ শ্লোগানটি দিতে উৎসাহিত করেন।

১৯৭০ সালের ২১ আগস্ট ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় প্রচার সম্পাদক স্বপন কুমার চৌধুরী স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণ শেষে বঙ্গবন্ধু “জয় বাংলা” শ্লোগানটি উচ্চারণ করেন। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের কন্ঠে “জয় বাংলা” শ্লোগানটি উচ্চারিত হয়। “জয় বাংলা” বাঙালির আত্মপরিচয়ের শ্লোগান, স্বাধীনতাকামী জনগণের ঐক্যবদ্ধের শ্লোগান, অর্জিত সাহসের শ্লোগান। বাঙালির হাতে অস্ত্র তুলে নেয়ার জন্য “জয় বাংলা” শ্লোগানটি ছিল বীজমন্ত্র।

১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ জয়বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজ।

একটি নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের জন্য নতুন জাতীয় পতাকার প্রয়োজন। নতুন পতাকা জাতির স্বীকৃতি। জাতির আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা, ভাষা, সংস্কৃতি তথা সংস্কৃতির পরিচয় জাতীয় পতাকা। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে নিউক্লিয়াস নামক একটি অংশের কর্ণধার সিরাজুল আলম খানের পরামর্শে পতাকা তৈরীর সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৭০ সালের ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের ইকবাল হলে পতাকা তৈরীর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এর সাথে সংশ্লিষ্টরা হচ্ছেন কাজী আরেফ আহমেদ, মনিরুল ইসলাম (মার্শাল মনি), আ স ম আব্দুর রব, শাজাহান সিরাজ, শরীফ নুরুল আম্বিয়া, হাসানুল হক ইনু, সালাহউদ্দীন ইউসুফ, স্বপন কুমার চৌধুরী, শিব নারায়ন দাস, চিশতী শাহ হেলালুর রহমানসহ ২২ জন। জয় বাংলা বাহিনী গঠনে ছাত্রলীগের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।

১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ডাকসুর ভিপি আ স ম আব্দুর রব লক্ষাধিক জনতার উপস্থিতিতে প্রথম এ পতাকা উত্তোলন করেন। ২৩ মার্চ পল্টন ময়দানে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে হাসানুল হক ইনু বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। পরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে যেয়ে তাঁর হাতে জয় বাংলা বাহিনী সদ্য তৈরী পতাকা হস্তান্তর করেন। তার বাড়িতে ও গাড়িতে পতাকা সংযুক্ত করা হয়। জয় বাংলা বাহিনীর প্রধান ছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর ভিপি আ স ম আব্দুর রব।

স্বাধীনতার স্থপতির সাথে মুজিববাহিনীর চার অধিনায়ক।

১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবানে ঐতিহাসিক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী সভায় সভাপতিত্ব করেন। কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন। ইশতেহারে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষণা করা হয়। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি” জাতীয় সঙ্গীত হবে বলে ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়। ইশতেহারে উল্লেখ ছিল আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক হবেন (সৈয়দ মিজানুর রহমান সম্পাদিত নেতৃত্বে ছাত্রলীগ ইতিহাসের অকাট্য দলিল)।

৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণের পর “জয় বাংলা” শ্লোগান জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ২৫ মার্চ গণহত্যা এবং বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার পর বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স অস্ত্র তুলে নেয়। গঠিত হয় মুজিববাহিনী। এ বাহিনী দেশকে চারটি সেক্টরের মাধ্যমে যুদ্ধ পরিচালনা করে। যশোর, খুলনা, ফরিদপুর, বরিশাল, কুষ্টিয়া ও পাবনা (সিরাজগঞ্জ বাদে) জেলা নিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল সেক্টর। এর সদর দপ্তর পশ্চিমবঙ্গের ব্যরাকপুর সেনানিবাস।

এ অঞ্চলের অধিনায়ক তোফায়েল আহমেদ, সহ-অধিনায়ক নূর আলম জিকু। রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, পাবনা, ও সিরাজগঞ্জ মহাকুমা নিয়ে উত্তরাঞ্চলীয় সেক্টর। এর সদর দপ্তর ছিল জলপাইগুড়ির কাছে পাংগা ক্যাম্প। অধিনায়ক-সিরাজুল আলম খান, সহ-অধিনায়ক-মনিরুল ইসলাম (মার্শাল মনি)। ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও সিলেট নিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টর। এর সদর দপ্তর মেঘালয়ের তুরা ক্যাম্প। অধিনায়ক-আব্দুর রাজ্জাক, সহকারী-সৈয়দ আহমদ, শাজাহান সিরাজ।

ঢাকা, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টর। এর ক্যাম্প ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায়। এখানকার অধিনায়ক-ফজলুল হক মনি, সহকারী-আ স ম আব্দুর রব। মুজিববাহিনী ও অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ। লিবারেশন ফোর্স বা মুজিববাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান কাজী আরেফ আহমেদ।

ভারতের উত্তর প্রদেশের দেরাদুনে টানডাওয়া, আসামের হাফলং-এ মুজিববাহিনীর উচ্চতর প্রশিক্ষণ হয়। প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পালন করেন ঐ সময়ের ছাত্রলীগ নেতা শরীফ নূরুল আম্বিয়া, হাসানুল হক ইনু, আ ফ ম মাহাবুব উল হক ও মাসুদ আহমেদ রুমী। মুজিববাহিনীর ট্রেনিং এ যুদ্ধ কৌশল প্রণয়নের দায়িত্বে ছিলেন ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল সুজন শিং উবান। ৯ মাসে সশস্ত্র যুদ্ধের পর দেশ শত্রুমুক্ত হয়। স্বাধীনতার জন্য ছাত্রলীগের ১৭ হাজার নেতা-কর্মীকে আত্মহুতি দিতে হয়। মুজিববাহিনী ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা স্টেডিয়ামে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র সমর্পন করে শিক্ষাঙ্গঁণে ফিরে যায়।




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!