খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ বৈশাখ, ১৪৩১ | ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Breaking News

  যশোরে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২.৬ ডিগ্রি, খুলনায় ৪১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে
  চুয়াডাঙ্গা ও পাবনায় হিট স্ট্রোকে ২ জনের মৃত্যু
  দাবদহের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়ল ৫ দিন, খুলবে ২৮ এপ্রিল

গণমানুষের নেতা এড. ফিরোজ আহমেদ

ড. খ. ম. রেজাউল করিম

৯ মার্চ এ্যাডভোকেট ফিরোজ আহমেদের ৯ম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৪ সালের এইদিনে খুলনার মেহনতি মানুষের নেতা এ্যাড. ফিরোজ আহমেদ মৃত্যবরণ করেন। তিনি অত্যন্ত মেধাবী, সুবক্তা, সদালাপী, স্পষ্টভাষী, বহুগুণের অধিকারী ছিলেন। তার দেশপ্রেম গণমানুষের প্রত্যাশা পূরণের রাজনীতি, শ্রমিক আন্দোলনে তার বলিষ্ঠ ভূমিকা খুলনাবাসী তাকে জনগণের নেতার পাশাপাশি নাগরিক নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।

সমাজে এমন কিছু ব্যক্তি থাকেন যারা তাদের চিন্তাধারার মাধ্যমে সমাজের দোষ-ত্রুুটিগুলোকে তুলে ধরে সংশোধনের দিক নির্দেশনা দেন এবং সমাজ বিকাশের পথ দেখিয়ে দেন। এসব ব্যক্তিরা নিজেরা হয়তোবা সমাজের উচ্চ পদে থাকেন না। কিন্তু সার্বিকভাবে সমগ্র সমাজের জন্য পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করে যান। তাদের চিন্তাধারা মানুষকে উদ্দীপ্ত এবং উদ্বুদ্ধ করে। ফলে মানুষ সচেতন হয়ে ওঠে এবং এক পর্যায়ে সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সক্রিয় হয়ে ওঠে। এ্যাড. ফিরোজ আহমেদ ছিলেন তেমনি একজন মানুষ। তিনি ছিলেন একাধারে রাজনীতিবিদ, আইনবিদ, লেখক, সুবক্তা এবং সমাজ ও পরিবেশ সচেতন মানুষ।

খুলনা তথা এ অঞ্চলের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে অবদানের কারণে তিনি খুলনার মানুষের মাঝে চিরভাস্বর হয়ে আছেন, থাকবেন। এ্যাডভোকেট ফিরোজ আহমেদ ছিলেন ভীষণ মেধাবী ও প্রতিবাদী মানুষ। ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় হোস্টেলের ডাইনিং-এ নি¤œমানের খাবার পরিবেশন করা
হলে তিনি এর প্রতিবাদ করেন। ফলশ্রুতিতে তাকে ক্যাডেট কলেজ ছাড়তে হয়। এরপর তিনি ভর্তি হন খুলনার বিখ্যাত সেন্ট যোসেফস স্কুলে। পরবর্তীতে খুলনার ঐতিহ্যবাহী সরকারি ব্র্রজলাল কলেজে ভর্তি হন। ছাত্রাবস্থায় তিনি রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। তিনি
ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। তিনি ১৯৭৯-৮০ শিক্ষাবর্ষে সরকারি ব্রজলাল কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। সুবক্তা, বিতার্কিক ও কর্মী হিসেবে কলেজের ছাত্র-শিক্ষক মহলে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ১৯৮০ সালে জার্মানীতে অনুষ্ঠিত
বিশ্ব ছাত্র সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে রাজনীতিতে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ছাত্রাবস্থায় দেশপ্রেম
চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেন। স্বাধীনতা উত্তরকালে ছাত্র ইউনিয়নের খুলনা জেলা কমিটির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ছিলেন। পরে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। তিনি আমৃত্যু এ দলের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। তিনি কমিউনিস্ট
পার্টির জনপ্রিয় নেতা কমরেড রতন সেনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। তিনি একাধিকবার দল থেকে মেয়র ও সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন।তার সাথে আমার প্রথম দেখা ২০০০ সালে কলকাতা থেকে দিল্লীগামী ট্রেনে। তিনি তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যসহ দিল্লী যাচ্ছিলেন। ট্রেনযাত্রার পর দিল্লী রেল স্টেশনের পাশে
পাহারগঞ্জে হোটেল সিলভার প্যালেসে আমরা এক সাথে ছিলাম। ট্রেনে বসেই দীর্ঘসময় ধরে সদালাপী মানুষটি খুলনায় তার নানামুখী কর্মকা-ের কথা একের পর এক বলেছিলেন। সেদিন তার কথা শুনে আমি এবং আমার সফরসঙ্গীরা কিছুটা বিরক্ত হয়েছিলাম। কথাগুলো আমাদের কাছে অতিরিক্ত মনে হয়েছিল। পরবর্তীতে ২০০২ সালে চাকরিসূত্রে খুলনাতে এসে বুঝতে পারি যে, তিনি তার যেসব কর্মকা-ের কথা সেদিন আমাদের কাছে বলেছিলেন তার বাইরেও তিনি অনেক কর্মকা-ের সাথে জড়িত ছিলেন। অর্থাৎ সেদিন তিনি কমই বলেছিলেন।
তিনি প্রায়ই আমি যে আবাসিক এলাকায় (নিরালা আবাসিক এলাকা) বসবাস করি সেখানে সকালে হাঁটতে আসতেন এবং প্রাত:ভ্রমণকারীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ
নিতেন। আমার সাথে তাঁর প্রায়ই দেখা হতো, কথা হতো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। দেখা হলেই তিনি কোনো না কোনো অনুষ্ঠানের দাওয়াত দিতেন, সমাজ নিয়ে ভাবতে বলতেন, বলতেন সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে সমাজের জন্য কিছু একটা করার কথা। আরো বলতেন ‘আপনার কাজই তো আমি করছি, আপনি আমার সাথে চলে আসেন’। আর যেটা নিয়মিত বিষয় ছিল সেটা হলো প্রায় প্রতিদিনই আমাকে মোবাইল বার্তা পাঠাতেন। তার মোবাইল বার্তা মানেই কোন অনুষ্ঠানের আগাম দাওয়াত। শুধু আমি নই, তিনি আমার মত অনেককেই মোবাইল বার্তা পাঠাতেন। আবার দু’একটা অনুষ্টানে যাবার জন্য মোবাইল ফোনে বিশেষভাবে অনুরোধ করতেন। খুলনার এমন কোন সভা সমিতি বা অনুষ্ঠান, মিছিল, অনশন ছিল না যেখানে তার সরব উপস্থিতি চোখে পড়েনি। তার সাথে বেশ কিছু সামাজিক ও
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছি। প্রায় অনুষ্ঠানে তার ভূমিকাই মুখ্য ছিল।

তিনি অপরাজেয় বাংলাদেশ ও সোস্যাল এক্টিভিটিজ ফর এনভায়রনমেন্ট (সেফ) নামে দু’টি বেসরকারি সংস্থার আইন উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতেন। আমিও ঐ সংস্থাগুলোর সাথে কিছুদিন কাজ করেছি। সেফ-এর প্রকাশনা ‘জীবনের কথা’য় ফিরোজ আহমেদের শ্রম
আইন ও মজুরি বিষয়ক অনেক লেখা প্রকাশিত হয়েছে। যার প্রতিটি এক একটি দলিল হিসেবে চিহ্নিত। তিনি মানুষ ও মানুষের কর্মকে খুব প্রশংসা করতেন। তিনি ছিলেন একজন পরিবেশকর্মী ও পরিবেশ সচেতন মানুষ। খুলনার দু:খ হিসেবে পরিচিত বিল ডাকাতিয়ার জলাবদ্ধতা, অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ, সুন্দরবন রক্ষা, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের বিরুপ প্রতিক্রিয়া ও নদীর অপরিকল্পিত শাসন নিয়ে ভাবতেন। সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে তেলবাহী ট্যাংকার ডুবির পর বনের মধ্যে দিয়ে তেলবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধের দাবীতে তিনি খুলনার সচেতন মহলকে নিয়ে জনমত গড়ে তোলেন। এ বিষয়ে তিনি বিভিন্ন সেমিনার,
পথসভা, আলোচনা সভা, মানববন্ধন করেন। তিনি দীর্ঘদিন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনে পরিবেশ আইন বিষয়ে দক্ষতার সাথে শিক্ষকতা করেন। এছাড়া তিনি
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা), খুলনা এর সমন্বয়কারী ছিলেন।তিনি ছিলেন অমায়িক, ভদ্র, সৎ, সদাচারী, সুবক্তা, প্রতিবাদী মানুষ। অর্থ সম্পদ তাকে
কখনো মোহগ্রস্থ করতে পারেনি বরং তিনি মানুষের কল্যাণের জন্য সবসময় কিছু করতে চেয়েছেন, সেজন্যে আজীবন মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন। অর্থবিত্তের দিকে ফিরে তাকাননি। কখনো নীতি বিসর্জন দেননি, পথভ্রষ্ট হননি। সব সময়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন। যেমন- বিদ্যুতের দাম বাড়লে, তেলের দাম বাড়লে প্রতিবাদ করতেন; তেমনিই খুলনার মিল শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করেছেন। বিভিন্ন
রাজনৈতিক দলের লোভনীয় হাতছানি থাকা সত্ত্বেও তিনি ক্ষমতার লোভে কখনো নিজের আদর্শ ও দলত্যাগ করেননি। তাই তিনি কোন পদে যাননি, বা ক্ষমতায় যাননি। সব সময় সমাজের দারিদ্র্য পীড়িত, শোষিত শ্রেণির কথা ভেবেছেন, তাদের জন্য কাজ করে গেছেন। তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক। দেশ এবং দেশের মানুষকে তিনি খুব ভালবাসতেন। দেশকে ভালবেসে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। দেশের যে কোন ক্রান্তিলগ্নে তার ভূমিকা ছিল সক্রিয়। কর্মজীবনে তিনি ছিলেন একজন সফল, জনপ্রিয় ও প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী। তিনি পরপর চারবার খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। তিনি ইচ্ছা করলে আইন ব্যবসা করেই লক্ষ লক্ষ টাকা
আয় করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি, বরং অনেক দরিদ্র মানুষকে বিনা পাশ্রিমিকে আইনি সহায়তা প্রদান করেছেন। মূলত তিনি সব সময় সাধারণ মানুষদের নিয়েই ভেবেছেন। তিনি প্রত্যক্ষভাবে খুলনার শ্রমিক আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। ট্রেড ইউনিয়ন খুলনা শহর কমিটির সম্পাদক ছিলেন। ছিলেন বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সদস্য। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটর ছিলেন। খুলনার প্রায় সকল শ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা ছিলেন। এছাড়া তিনি বহু গ্রন্থ ও প্রবন্ধের রচয়িতা।

এ্যাড. ফিরোজ আহমেদ ছিলেন একজন উদ্ভাবনপ্রিয় মানুষ। খুলনার আপামর জনসাধারণ তাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করতেন। তিনি সমাজ ও মানবতার জন্য সারাজীবন কাজ করেছেন। তার দেশপ্রেম, ভালবাসা, আদর্শ, নৈতিকতাবোধ ছিল প্রবল। এ্যাডভোকেট ফিরোজ আহমেদ ছিলেন একজন অনুসরণীয় আদর্শ মানুষ। সমাজের প্রতিটি মানুষের এই মহৎ মানুষটির দেখানো পথ অনুসরণ করা দরকার। এমন বিদগ্ধ বিরল ব্যক্তিত্বের কাছে দেশ ও জাতি ঋণী থাকবে,এটাই স্বাভাবিক প্রত্যাশা।

লেখক : সমাজ গবেষক ও শিক্ষক
সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর।




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!