খুলনা, বাংলাদেশ | ৫ বৈশাখ, ১৪৩১ | ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

Breaking News

গণমাধ্যমে খুলনার রণাঙ্গন

কাজী মোতাহার রহমান

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নবম সেক্টরের বিভিন্ন এলাকা চূড়ান্ত আক্রমনে পরিকল্পনায় সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল (বামে), মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্ণেল এম এ জি ওসমানী (মাঝে), সাবসেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা...ছবি মোহাম্মদ আলম।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে উজ্জলতম অর্জনপর্ব। অঙ্গীকারে, সাহসে, বীরত্তে, আত্মত্যাগে আলোকময় এমন সময় বাঙালির ইতিহাস আর কখনোই আসেনি। আবার এতো মৃত্যু, নৃশংসতা নির্বিচারে গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, ঘরবাড়ি ছেড়ে বিপুল সংখ্যক শরনার্থী হয়ে যাওয়ার ঘটনাও এ ভূখন্ডে কখনো ঘটেনি। বাঙালি জাতির ধারাবাহিক আন্দোলন ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনার ফসল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। এ যুদ্ধ ছিল আমাদের জাতিসত্তা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও আত্ম-অনুসন্ধানের লড়াই। আমাদের অহংকার আর আত্মপরিচয় তুলে ধরার ভিত্তি হচ্ছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ।

স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে পহেলা মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট সামরিক জান্তা জেনাঃ ইয়াহিয়া খান ১১০ নং সামরিক বিধি জারি করে। এ বিধিতে বলা হয় ‘পাকিস্তানের অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোন ছবি, খবর, অভিমত, বিবৃতি, মন্তব্য ইত্যাদি প্রকাশ থেকে সংবাদপত্রকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। এ আদেশ লংঘনকারীর সর্বোচ্চ শাসিÍ ১০ বছরের সশ্রম কারাদন্ড।’ একাত্তরের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সেদিন রেডিও পাকিস্তান থেকে প্রচার হয়নি। গল্লামারীতে স্থাপিত রেডিও পাকিস্তান, খুলনা কেন্দ্র ১ মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেয়। ৮ মার্চ এ বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ প্রচার হয়। প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ১১০ নম্বর সামরিক বিধি ও ২৬ মার্চ জারি করা ৭৭ নম্বর সামরিক বিধি সারাদেশের ন্যায় খুলনার সাংবাদিকরা ভঙ্গ করে। ৭৭ নম্বর সামরিক বিধিতে বলা হয় পাকিস্তানের অখন্ডতা বা সংহতির বিরুদ্ধে এবং কায়দে আজমের প্রতি অশ্রদ্ধা ও অবমাননার সংবাদ প্রকাশ করলে শাস্তি হবে সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদন্ড।
১৯৭১ সালের ২০ মার্চ লুৎফর রহমান জাহাঙ্গীর সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘দেশের ডাক’ পত্রিকায় বাংলাদেশের মানচিত্র ছাপা হয়। দেশের ডাকের অফিস ছিল ক্লে রোডস্থ হ্যানিম্যান ফার্মেসীর কাছে। এ অপরাধে ২৬ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী দেশের ডাকের নটোরাজ প্রেস (আজকের আইএফআইসি ব্যাংক) জ¦ালিয়ে দেয়। আর কখনো ‘দেশের ডাক’ প্রকাশিত হয়নি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর খুলনার কোন পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়নি।

১ মে ১৯৭১, দৈনিক আজাদের প্রতিবেদন
খুলনা শহরের দৌলতপুরের দেয়ানায় শান্তি কমিটির কেন্দ্রীয় সমাবেশে জাতীয় পরিষদের সাবেক সদস্য আব্দুস সবুর খান সভাপতির ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন, দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে হবে। সভায় প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য আব্দুল হামিদ, আবুল হোসেন এবং কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির সেক্রেটারী মোহাম্মদ আলী বক্তৃতা করেন।

স্টেটসম্যানের খবর (জুন ১৯৭১)
একাত্তরের জুন মাসের শেষের দিকেই পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী প্রচার করতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি শান্ত। দেশত্যাগীরা ফিরে আসতে পারে। এ কারণে বিদেশী সাংবাদিকদের সফর করানোর ব্যবস্থা করা হয়। ২৫ মার্চে গণহত্যার কারণে ঢাকায় অবস্থানরত বিদেশী সাংবাদিকদের দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়। পালিয়ে ছিলেন সাইমন ড্রিং নামক একজন বিদেশী সাংবাদিক।

জুনে পূর্ব পাকিস্তান সদরে আসা বিদেশী সাংবাদিকদের মধ্যে ছিলেন দিল্লী থেকে প্রকাশিত ইংরেজি দি স্টেটসম্যান এর মারি সাইল (গৌরাঙ্গ নদী রচিত বৃহত্তর খুলনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস)। তিনি তখন দক্ষিণাঞ্চলের বড় শহর খুলনায় আসেন। খ্যাতিমান এই সাংবাদিক তার প্রতিবেদনে মতিউল্লাহ গুন্ডা নামক এক ব্যক্তির মরদেহ নদীতে ভেসে আসার কথা উল্লেখ করেন। প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিল, “খুলনায় কতজনকে হত্যা করা হয়েছে তা আমি জানি না। তবে একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, একদিন দশ মিনিটে তিনি নদী দিয়ে ৪৮টি লাশ ভেসে যেতে দেখেছেন।”

তিনি প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করেন, “সবচেয়ে লজ্জার ব্যাপার হচ্ছে পাকিস্তানে সমান্তরাল দু’টি সরকার চলছে। একটি সিভিল প্রশাসন, যা ক্রমেই স্থবির হয়ে পড়েছে। অন্যটি “ঞযব ড়ঃযবৎ ধ ৎবমরসব ড়ভ ঢ়ধরফ রহভড়ৎসবৎং নরমড়ঃং ধহফ ঃযঁমং ধহংবিৎধনষব ঃড় হড় ড়হব ধঢ়ঢ়ধৎবহঃষু ধনড়াব যিধঃবাবৎ ষধি রহ ঊধংঃ চধশরংঃধহ.”

সাংবাদিক মারি সাইল খুলনা শহরতলীর আড়ংঘাটা সফরের কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, “এই গ্রামে ছিল দু’ভাই। হামিদ ও শওকত। একদিন তারা দুই ট্রাক সৈন্য নিয়ে আড়ংঘাটা গ্রামে আসে। গ্রামের কিছু লোকজনের সঙ্গে পাকিস্তানী সৈন্যদের তর্ক হলে তাৎক্ষণিক তারা ছয়জনকে গুলি করে হত্যা করে। গ্রামের দেড়শ’ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ এসব দেখে এলাকা ত্যাগ করে। আড়ংঘাটায় চারজন মুসলিম চাষী কি হচ্ছে জানতে এগিয়ে এলে সৈন্যরা তাদেরকে কোরআন শরীফ থেকে একটি সূরা পাঠ করতে বলেন। তারা বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম বলা শুরু করলে সৈন্যরা বলে, এটা ওদের চালাকি। ‘ওরা মুসলমান নয়’ বলে চারজন চাষীকে পাক সেনারা হত্যা করে।”

সাংবাদিক মারি সাইলকে খুলনা সদর দপ্তরে কর্মরত লেঃ কর্ণেল শামস জানান, “বাঙালিরা ভীতু, যুদ্ধ করতে জানে না। তিন মাসে তারা খুলনা শহরমুক্ত করেছেন। রাজাকাররা তাদের সাহায্য করছে, তাদের হাতে রাইফেল তুলে দেয়া হয়েছে। বিদেশী এই সাংবাদিক মারি সাইল-এর সঙ্গে দেখা হয়েছিল আব্দুল ওহাব মহালদার নামক একজন রাজাকার কমান্ডারের সাথে। এই রাজাকার কমান্ডারের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, “খুলনায় ইতোমধ্যে দুইশ’ রাজাকার ও শান্তি সদস্যদের হত্যা করেছে মুক্তিবাহিনী। তারা দু’জন দুস্কৃতকারীকে (মুক্তিযোদ্ধা) হত্যা করেছে।”

বাংলাদেশ ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
২৪ আগস্ট ১৯৭১। মুক্তিযোদ্ধারা খুলনা জেলার মোংলা বন্দরে গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে ছয়টি জাহাজ ডুবিয়েছে, দু’টি আটক করেছে। ছয়টির মধ্যে দু’টি মার্কিন, দু’টি চীনা, একটি জাপানী এবং একটি পাকিস্তানী।

নয় ঘন্টা যুদ্ধ :

বিপ্লবী বাংলাদেশ, ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
খুলনা ৩০ আগস্ট। গত ৩ আগস্ট খুলনার উকসা-গোবিন্দপুরে মুক্তিবাহিনীর শক্তিশালী ঘাটির ওপর প্রায় চারশ’ পাক সেনা আক্রমণ চালালে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। ভোর ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। বাংলাদেশের বীর বিপ্লবী মুক্তিযোদ্ধারা দীর্ঘ ৯ ঘন্টা যুদ্ধের পর শত্রু সেনাদের তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়।

গত ১৫ দিনে সাতক্ষীরার সাড়ে ৬৩ বর্গমাইল মুক্ত

কালান্তর, কলকাতা, ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
কলকাতা ১৬ সেপ্টেম্বর। গত ১৫ দিনে খুলনা জেলার সাতক্ষীরার মহাকুমার সাড়ে ৬৩ বর্গমাইল অঞ্চল থেকে মুক্তিবাহিনী খান সেনাদের হটিয়ে দিয়ে মুক্ত এলাকা স্থাপন করেছে। গতকাল টাকীতে এই তথ্য বিশ্বস্ত সূত্রে পাওয়া গেল।

ঐ একই সময়কালের মধ্যে মুক্তিবাহিনী ১৯৭ এপিমাইন (যেগুলো পাকবাহিনী পুঁতে রেখেছিল) তুলে নিয়ে এসেছে, ৩ টন ওজনের চারটি পাক সামরিক গাড়ি ধ্বংস করেছে এবং তিনটি সীমান্ত চৌকি দখল করেছে। তাছাড়া আরও জানা গেছে, মুক্তিবাহিনীর হাতে ১৭টি রাইফেল এবং ২ হাজার রাউন্ড ৩০৩ রাইফেলের বুলেটসহ ৩০ জন রাজাকার বন্দী হয়েছে। এই ঘটনার পর থেকে ঐ অঞ্চলের রাজাকাররা মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মোটামুটি সহযোগিতা করছে।

হরিনগরে চারটি লঞ্চ ডুবেছে

বাংলার বাণী, ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
খুলনা জেলার শ্যামনগর থানার হরিনগরে মুক্তিযোদ্ধারা ১৩ সেপ্টেম্বর হানাদার বাহিনীর চারটি লঞ্চ ডুবিয়ে দেয়।

খুলনায় দু’জন পাকসেনা খতম

জয় বাংলা, ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
গত ১৩ সেপ্টেম্বর খুলনা জেলার শ্যামনগর থানার হরিনগরে গেরিলা যোদ্ধারা একটি পাকিস্তানী গানবোটের ওপর হাতবোমা নিক্ষেপ করে দু’জন পাকসেনাকে হত্যা করেছেন। গানবোটটি পানিতে ডুবে যায়।

তিন দিন ব্যাপী যুদ্ধ

বাংলার বাণী, ৫ অক্টোবর ১৯৭১
গত মাসের শেষ সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধারা খুলনা জেলার সাতক্ষীরা মহাকুমার অন্তর্গত কাকডাঙ্গা, মাদ্রা এবং বোয়ালিয়া এলাকায় এক ব্রিগেড শত্রু সেনাদের সাথে যুদ্ধ হয়। এই খন্ডের যুদ্ধে চারশত পাকসেনা খতম হয়েছে বলে প্রত্যক্ষদর্শী গ্রামবাসীর নিকট থেকে জানা যায়।

খান সেনা ও মুক্তিফৌজ এর মধ্যে কামানের লড়াই

আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ অক্টোবর ১৯৭১
কৃষ্ণনগর ৫ অক্টোবর। গত পহেলা অক্টোবর সন্ধ্যার দিকে বাংলাদেশের খুলনা সেক্টরের সাতক্ষীরার অধীন উকসায় খান সেনা ও মুক্তিফৌজ এর মধ্যে প্রচন্ড কামানের লড়াই হয়। ঘন ঘন কামানের শব্দ ভারতীয় সীমান্ত এলাকা থেকেও শোনা যায়।

মুক্তিফৌজ সূত্রে প্রাপ্ত বিশদ বিবরণে জানা গেছে যে, এক ব্রিগেড খান সেনা (সংখ্যায় প্রায় ৬শ’ জন) ২৩টি ট্রাকে করে সাতক্ষীরা থেকে কালিগঞ্জ থানার অন্তর্গত উকসার মুক্তিফৌজের ঘাটি আক্রমণ করার জন্য অগ্রসর হয় এবং ভারী কামান থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করে। মুক্তিবাহিনীও তাদের মর্টার থেকে গোলাবর্ষণ করে তার উপযুক্ত জবাব দেয়। মুহূর্মুহূ কামানের গোলাবর্ষণের শব্দে ভারতীয় সীমান্ত এলাকাও কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকে। মুক্তিফৌজের প্রচন্ড প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে খান সেনারা উকসার কিছু দূরে পিছিয়ে যায় এবং সেখানে অবস্থানরত থাকে। এই লড়াইয়ের ক্ষয়ক্ষতির বিশদ বিবরণ এখনও না পাওয়া গেলেও কয়েকজন খান সেনা নিহত হয়েছে এবং একজন মুক্তিফৌজ আহত হয়েছে বলে জানা গেছে।

অপর এক সংবাদে জানা গেছে, গত ২৮ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরার শ্যামনগরের কাছে এক স্থানে একটি পাকিস্তানী গানবোট মুক্তিফৌজের একটি ঘাটির ওপর গোলাবর্ষণ করলে উভয়পক্ষে প্রচন্ড গুলি বিনিময় হয়। পাক গানবোটটিকে দু’টি বড় মর্টার লঞ্চ পাহারা দিয়ে নিয়ে আসে। কিছুক্ষণ উভয়পক্ষে গুলি বিনিময়ের পর পাক গানবোট পশ্চাদপসরণ করে। পাক সেনাদের ক্ষয়ক্ষতির সংবাদ জানা যায়নি। মুক্তিফৌজের পক্ষে তিনজন অল্প বিস্তর আহত হয়।

খুলনা সেক্টরে ৫শ’ খান সেনা নিহত
মুক্তিফৌজের হিসাবে দেখা গেছে, গত দু’মাসে মুক্তিফৌজের হাতে খুলনা সেক্টরের বিভিন্ন স্থানের লড়াইয়ে ৫শ’ খান সেনা ও দুইশ’ রাজাকার নিহত হয়েছে। এছাড়া পাক সেনাদের ৬শ’ রাইফেল দখল করা হয়েছে এবং ৬০ জন রাজাকার মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। পাঞ্জাবি পুলিশ (বাংলাদেশে এখন পাঞ্জাবি পুলিশ আমদানি করা হয়েছে) ও আট জন খান পুলিশ নিহত হয়েছে। তাছাড়া ৬৬টি খান সেনাদের রাইফেল মুক্তিফৌজের হস্তগত হয়েছে। মুক্তিফৌজ খান সেনাদের দু’টি লঞ্চ, একটি গান বোট ধ্বংস করেছে ও একটি লঞ্চ হস্তগত করেছে।

মেজর মঞ্জুরের ৯নং সেক্টরের সফর

সম্প্রতি ৮নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর মঞ্জুর ৯নম্বর সেক্টর সফর করে মুক্তিবাহিনীর কর্মতৎপরতা দেখে মুগ্ধ হন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনাদের বীরত্বে অতি শীঘ্রই বাংলাদেশ থেকে হানাদার বর্বররা বিতাড়িত হবে।

শ্যামনগর-কালিগঞ্জ দুর্জয় ঘাঁটি কিন্তু ….

সাংবাদিক মিন্টু বসু, বিপ্লবী বাংলাদেশ ১০ অক্টোবর ১৯৭১
শারদীয়ার ছুটি অতএব, হাতে প্রচুর সময়। কেননা এবারতো আর পূঁজোর ব্যবস্থা নেই। তাই ভেবে চিন্তে ঠিক করলাম, মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি পরিদর্শন করতে যাব। ২৭ সেপ্টেম্বর বৈকাল ৪টায় আমরা চারজন বেরিয়ে পড়লাম। সম্পাদক নূরুল আলম ফরিদ, কর্মধক্ষ মোঃ ইউসুফ, একজন মুক্তিযোদ্ধা ফিরোজ বাঙালি এবং আমি। কিছু দূর এগোতেই শেলিংয়ের শব্দ শুনতে পেলাম। গ্রামের লোকমুখে শুনলাম, মুক্তিবাহিনী বসন্তপুরের পাক ছাউনি আক্রমণ করেছে। মনে হলো ওই বিকটাকার শব্দগুলো যেন আমাদেরকে সাদর সম্ভাষণ জানাচ্ছে। দ্রুত এগিয়ে চললাম। তখন রাত ৮টা। ঘাঁটির কাছাকাছি এসে পৌঁছালাম। এবার আমাদেরকে অতিসন্তর্পণে এগুতে হবে। কেননা দুই পক্ষেই গোলাগুলি হচ্ছে অতএব এবার আমরা ক্রোলিং করে এগোতে লাগলাম। এমনভাবে কিছুদূরে এগোনোর পর ঘাঁটিতে এসে পৌঁছালাম। এর কিছুক্ষণ বাদেই গোলাগুলি থেমে গেল। আরও পরে ক্যাপ্টেন হুদা এবং ১১জন মুক্তিযোদ্ধা সমস্ত গায়ে কাঁদামাখা অবস্থায় ক্যাম্পে ফিরে এলেন, তার মুখেই শুনলাম বসন্তপুরে তিনি স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলতে সক্ষম হয়েছেন, দুঃসাহসী ক্যাপ্টেন এবং তার সেনাদের প্রতি শ্রদ্ধায় স্বভাবতই মাথাটা নুয়ে এলো। মনে মনে বললাম, বাংলাদেশ আজ আর দুর্বল নয়। বাংলার এই দুর্জয় শক্তি, আমার জননী জন্মভূমিকে মুক্ত করবেই।

কয়েকশত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে লাইনে বসে আহার পর্ব সমাধা করে তাঁবুর নীচে রাতের মত আশ্রয় নিলাম। ভোরের ঘুম ভাঙলে আবার সেই শব্দ। শুনলাম শ্যামনগর ও কালীগঞ্জ দখল করার জন্য পাকসেনারা আমাদের ওপর আক্রমণ করেছে। হাত-মুখ ধুয়ে আসতেই ক্যাপ্টেন সাহেবের চায়ের টেবিলে ডাক পড়লো আমাদের। সবে গিয়ে বসেছি ঠিক তখনই সংবাদ এলো পাক সেনারা পিরোজপুরে বাঙ্কার দখল করে নিয়েছে। তাই ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা এবং গোলাবারুদ পাঠাতে হবে। দেখলাম মুহূর্তের মধ্যে ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ক্যাপ্টেন সাহেব যাবার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন। হঠাৎ আমরা স্থির করলাম এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবো। ক্যাপ্টেন সাহেবকে বলায় তিনি সব ব্যবস্থা করে দিলেন। বেলা ১০টায় গিয়ে পৌঁছালাম শ্যামনগর থানার অদূরে পিরোজপুর নামক গ্রামে। আমাদের যেখানে ডিফেন্স ছিল তার থেকে দু’শ গজ দূরে শত্রু সৈন্য দাঁড়িয়ে। দেখলাম দু’শ গজ দূরে আমাদের বাঙ্কারের মধ্যে খান সেনারা। দুই পক্ষেই সমানে গোলাগুলি চলছে। শুনলাম এর মধ্যেই ৫০-৬০ জন রাজাকারসহ শত্র“ সৈন্য খতম হয়েছে আমাদের অসম সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। ক্যাপ্টেনের নির্দেশে আমরা ৫শ’ গজ পেছনে সরে এলাম ঠিক চৌমাথার ওখানে। সেখান থেকেই থ্রিইঞ্চি মর্টার দিয়ে সেলিং শুরু করলেন ক্যাপ্টেন সাহেব। সমস্ত দিনটা সেখানেই কেটে গেল।
সবচেয়ে আশ্চার্যের যে, দুই পক্ষের সমানে গোলাগুলি চলছে আর তার মধ্যেও গ্রামের জনগণ বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করে চলেছে। কেউ গোলাবারুদ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আবার কেউ মুক্তিবাহিনীর খাবার তৈরি করছে, আবার কেউ ডিফেন্স থেকে সংবাদ এনে দিচ্ছে। প্রতিটি জনগণের দৃঢ় বিশ্বাস মুক্তিবাহিনী হানাদারদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হবে। হঠাৎ দেখলাম জনৈক মুক্তিযোদ্ধা কালীগঞ্জের দিক থেকে ছুটে আসছেন। কাছে আসতে জানতে পারলাম কালীগঞ্জে চার জন পাক সেনা খতম হয়েছে। ক্যাপ্টেন হুদা ধন্যবাদ জানালেন ওই সময়ের সাহসী মুক্তিযোদ্ধাকে।

এক বৃদ্ধ এলেন কয়েকটি ডাব নিয়ে। এই বৃদ্ধের একমাত্র ছেলে ডিফেন্সে যুদ্ধ করছে। ছেলেকে না পেয়ে ডাবগুলো সব আমাদের মধ্যে বিতরণ করে দিলেন। ছেলের জন্য একটি রাখতে বলায় তিনি বললেন আপনারাতো আমার ছেলে। বৃদ্ধের দৃঢ় এই মনোবল সবাইকে মুগ্ধ করল। একজন তরুণ মুক্তিসেনা আহত হয়েছে তাড়াতাড়ি পৌঁছে দিতে হবে তাকে হাসপাতালে। ভার পড়ল আমাদের ২-৩ জনের ওপর। অনিচ্ছা সত্বেও আহত সৈনিককে নিয়ে ফিরে চললাম দুর্জয় ঘাঁটি শ্যামনগর পরিত্যাগ করে। হে দুর্জয় ঘাঁটি শ্যামনগর তোমায় অভিনন্দন-বাংলার শক্তিকে, যারা শ্যামনগর মুক্ত রাখার জন্য জীবনপণ যুদ্ধ করে চলেছে বাংলার স্বাধীনতার লাল সূর্যকে। কয়েকদিন পর জনৈক মুক্তিযোদ্ধা দুঃসংবাদ বহণ করে নিয়ে এলেন শ্যামনগর ও কালীগঞ্জ হানাদাররা দখল করেছে। শোনার সঙ্গে সঙ্গে পাথরের মতো হয়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।

আমার সোনার বাংলা কি তবে দখলদারদের থেকে মুক্ত হবে না ? ভাবনার অবসান করলেন মুক্তিযোদ্ধাই “ভাবছেন কেন, এ তো সাময়িক পরাজয়, দেখবেন কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা হানাদারদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হবো।

তাছাড়া গেরিলাযুদ্ধের নিয়মই তো এমনি। এরপর কালীগঞ্জ ও শ্যামনগর থেকে কী কারণে মুক্তিযোদ্ধারা সরে এলেন সে সম্পর্কে জানতে চাইলাম উত্তরে বললেন “আমাদের সবচেয়ে অস্ত্রের অভাব, যার জন্য এ সাময়িক পরাজয়। আমাদের কাছে অস্ত্র বলতে রাইফেল, এল এম জি, দু’একটি থ্রিইঞ্চি মর্টার আর ওরা আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত, কাজেই ওদের মতো যদি আমাদের আধুনিক অস্ত্র থাকতো তো বুঝিয়ে দিতাম মুক্তিযোদ্ধারা কত দুর্বার।

বিজয় বার্তা : কুষ্টিয়া-যশোর ও খুলনা রণাঙ্গন

বিপ্লবী বাংলাদেশ, ২৪ অক্টোবর ১৯৭১
দুঃসাহসিক মুক্তিযোদ্ধার খুলনার “চাউলা হাচানের’ বিউটি অব খুলনা নামক লঞ্চখানা কোনো এক গ্রাম থেকে হাইজ্যাক করে মুক্তাঞ্চলের মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটিতে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া খুলনার দুই জন কুখ্যাত মুসলিম লীগ দালালকে বন্দী করে নিয়ে এসেছেন। উক্ত দালাল দু’জন বন্দী হওয়ায় স্থানীয় গ্রামের জনগণ এত দিনের নির্যাতন থেকে মুক্তি পেল। এ জন্য জনগণ মুক্তিবাহিনীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ উক্ত দালাল দু’জন লঞ্চযোগে খুলনায় যাচ্ছিল রাজাকার এবং পাক সেনাদের নিয়ে আসতে। এই সংবাদ পেয়ে একদল মুক্তিবাহিনী অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে এই সাফল্য অর্জন করে।

৯ অক্টোবর খুলনা জেলার অর্ন্তগত বাগেরহাট মহাকুমায় পাকসেনারা মুক্তিবাহিনী দ্বারা আকস্মিকভাবে আক্রান্ত হয় এবং এই বীরত্বপূর্ণ আক্রমণে একজন অফিসারসহ ১০ জন পাক আক্রমণকারী শত্রুসেনা নিহত এবং অনেকেই গুরুতর আহত হয়। মুক্তিবাহিনী এখান থেকে অনেক অস্ত্র-শস্ত্র দখল করেন।

খুলনায় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে হানাদারবাহিনী নাস্তানাবুদ

বাংলার বাণী, ২ নভেম্বর ১৯৭১
বাংলার অগ্নিসন্তান মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের জলাঞ্চল ফরিদপুর, বরিশাল এবং খুলনা জেলার বিভিন্ন এলাকায় তাহাদের গেরিলা তৎপরতা জোরদার করিয়াছেন।

গত ১৭ অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধারা খুলনা জেলার – এলাকায় লালসিয়া নামক একটি বড় জাহাজ এবং একখানি বার্জ ডুবাইয়া দিয়া জঙ্গী শাসকদের মনে আতংকের সৃষ্টি করিয়াছেন। এই জাহাজটি খুলনা নিউজপ্রিন্ট কারখানার জন্য সুন্দরবন এলাকা হইতে কাঁচামাল সরবরাহের কাজে ব্যবহৃত হইত। ইদানিং এটি খান সেনাদের চলাচলের জন্যও সরবরাহ করা হইত বলিয়া জানা যায়।

গত ২৩ অক্টোবর স্বাধীনতা সংগ্রামীরা খুলনা জেলায় আশাশুনি এলাকায় একটি রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ চালাইয়া ৬৪ জন রাজাকার খতম এবং ৪০ জনকে মারাত্মকভাবে জখম করে। এই সময় তাহারা ৫টি রাইফেলও দখল করেন। একইদিনে তাহারা খুলনা জেলার পাটকেলঘাটায় হানাদার বাহিনীর ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালাইয়া ১৫ জন খান সেনা খতম করেন। ইহা ছাড়া তাহারা খুলনার শ্যামনগর এবং ভাতশালা এলাকায় খান সেনাদের ওপর পৃথক আক্রমণ চালাইয়া এগারো জন দস্যুসেনা খতম করেন।

ব্রিটিশ জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত

বিপ্লবী বাংলাদেশ ১৪ নভেম্বর ১৯৭১
বাংলাদেশের গেরিলারা চালনা বন্দরে একখানা ব্রিটিশ জাহাজের ওপর গুলিবর্ষণ করলে জাহাজটি চালনা ছেড়ে পালিয়ে কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছে বলে জানা গেছে। জাহাজটির প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। জাহাজটির নাম ‘সিটি অব সেন্ট আলবানাস’। জাহাজটি গত বুধবার দিন কলকাতা থেকে খুলনার চালনা বন্দরে এসেছিল পাট নিয়ে বিদেশে যাবে বলে।
খবরে আরও জানা গেছে, জাহাজটি চালনা বন্দর ছেড়ে কলকাতায় আশ্রয় নিলে সেখানে অবস্থানরত অন্যান্য বিদেশী জাহাজগুলো বাংলাদেশে আসতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

২০ জন শত্রুসেনা নিহত
খুলনার শ্যামনগর থানার কৈখালী নামকস্থানে মুুক্তিবাহিনীর সাথে পাক সেনাদের এক সংঘর্ষ ঘটলে দু’জন পাকসেনাসহ ৬ জন রাজাকার নিহত হয় এবং বেশকিছু সংখ্যক পাক সেনা জখম হয়। মোল্লাহাট থানার চারকুলিয়া গ্রামের সন্নিকটে মুক্তিবাহিনী আক্রমণ চালালে ক্যাপ্টেন সেলিমসহ বারোজন হানাদার নিহত হয়।

মুক্তিবাহিনী খুলনার দিকে

আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬ নভেম্বর, ১৯৭১
মুক্তিবাহিনীর সূত্রে ঘোষণা করা হয়, সাতক্ষীরা মহাকুমার প্রতিটি থানা মুক্ত হয়েছে। মুক্তিবাহিনী এখন খুলনার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!