খুলনা, বাংলাদেশ | ১০ বৈশাখ, ১৪৩১ | ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

Breaking News

  রাজধানীর সদরঘাটের শ্যামবাজারঘাটে লঞ্চে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে
  বান্দরবানের তিন উপজেলায় ভোট স্থগিত : ইসি সচিব
  নাটোরে দুই ট্রাকের সংঘর্ষে এক ট্রাক ড্রাইভার নিহত

খুলনা জেলা প্রশাসকের কপিলমুনি প্রত্নতাত্ত্বিক ঢিবি পরিদর্শন

শেখ নাদীর শাহ্, পাইকগাছা

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খননকৃত খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনি ঢিবি পরিদর্শন করেছেন খুলনা জেলা প্রশাসক মো: মনিরুজ্জামান তালুকদার। মঙ্গলবার (১৭ মে) সকালে তিনি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খননে বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে উঠে আসা সম্ভাব্য বৌদ্ধ বিহার পরিদর্শন করেন।

এসময় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনার আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা, পাইকগাছা উপজেলা চেয়ারম্যান আনোয়ার ইকবাল মন্টু, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মমতাজ বেগম, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহরিয়ার হক, ইউপি চেয়ারম্যান কওছার আলী জোয়াদ্দারসহ স্থানীয় সাংবাদিক ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন।

এসময় জেলা প্রশাসক মো: মনিরুজ্জামান তালুকদার বলেন, খননে উঠে আসা বিভিন্ন প্রত্নবস্তুর নমুনা ও কাঠামো দেখে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কাছে মনে হয়েছে প্রত্নবস্তু সমূহ নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দির। তিনি এ অঞ্চলের প্রত্নভান্ডার উদ্ধার ও তা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আগামীতে সেখানে দীর্ঘ মেয়াদী খনন পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে বলেন, এ অঞ্চলের মানববসতি, তাদের সংষ্কৃতি ও জীবনযাত্রা সম্পর্কে অবহিতপূর্বক সেখানে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুলতে প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকার জমি অধিগ্রহণসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনে সব ধরনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে।

এসময় আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা জেলা প্রশাসককে উদ্ধারকৃত প্রত্নবস্তু, স্থাপনা, স্থাপত্যশৈলী ঘুরে ঘুরে দেখান। এসময় তিনি বলেন, কপিলমুনি ঢিবি (রেজাকপুরস্থ) এলাকায় দীর্ঘ মেয়াদেী বিস্তারিত খননে উঠে আসতে পারে কোন পরিপূর্ণ বৌদ্ধ বিহার।

উল্লেখ্য, ইতিহাসের খোঁজে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খননে একের পর এক উঠে আসছে প্রাচীণ স্থাপত্যকাঠামো ও প্রত্নবস্তু। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দাবি, স্থাপনাগুলো নবম থেকে দ্বাদশ শতকের। পর্যায়ক্রমে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ঢিবিগুলো খননে প্রাপ্ত নমুনার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় উঠে আসতে পারে সুনির্দিষ্ট শাসনামলের সময়কাল, প্রাচীণ স্থাপত্যশৈলী এবং সেখানে বসবাসকারীদের সম্পর্কে বিষদ ধারণা। স্থানীয়রা বলছেন, আশপাশের কয়েকটি গ্রামজুড়ে রয়েছে এমন অনেক পুরনো ঢিবি।

মাত্র এক মাস বরাদ্দের খননে খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনি ইউনিয়নের রেজাকপুর শিংয়েরবাড়ি ঢিবিতে খুলনা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খননে দৃশ্যমান নবম হতে দ্বাদশ শতকের স্থাপত্যকাঠামো। ইতোমধ্যে সেখানকার পাওয়াগেছে, প্রাচীণ আমলের বিভিন্ন ধরনের মৃৎপাত্র, মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ, পোড়া মাটির ফলক, প্রতীমার ভগ্নাংশ, অলংকৃত ইট, বিনিময় মাধ্যম কড়িসহ বিভিন্ন ধরনের প্রত্নতত্ত্ব বস্তু।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খননের সফলতা নীরিক্ষণপূর্বক পরিদর্শনে গত ২৩ এপ্রিল অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রতন চন্দ্র পন্ডিত খননস্থল পরিদর্শন করেছেন। এসময় অধিদপ্তরের উপরিচালক (প্রশাসন) মাইনুর রহিম, উপপরিচালক (প্রত্ন) ড. মো. আমিরুজ্জামান, আঞ্চলিক পরিচালকের কার্যালয়, খুলনার আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা, কাস্টোডিয়ান বাগেরহাট মোহাম্মদ যায়েদ, ফিল্ড অফিসার মো. আল আমীনসহ খনন টিমের সদস্যবৃন্দ, খনন শ্রমিকগণ ও স্থানীয় ভূমি মালিকগণ উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সুন্দরবনে জরিপ ও মিডিয়ায় সাম্প্রতিক বিভিন্ন কার্যক্রম দেখে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়ে পরিদর্শনে আসেন, সুন্দরবনের প্রাচীন মানববসতির লবণ তৈরির পাত্র ও চুল্লি নিয়ে কাজ করা জার্মান গবেষক।

 

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা বলেন, কপিলমুনিস্থ সিংয়ের বাড়ি ঢিবি খননে দৃশ্যমান স্থাপত্যকাঠামোর দৈর্ঘ্য আনুমানিক ২৫০ মিটার ও প্রস্থ ১৮০ মিটার। ঢিবির দক্ষিণাংশ খননে একটি বর্গাকার স্থাপত্যকাঠামো স্পষ্ট। যেখানে একটি বর্গাকার কক্ষ উঠে এসেছে। কক্ষটিকে ঘিরে দেওয়াল দিয়ে বেষ্ঠিত একটি প্রদক্ষিণ পথ রয়েছে। মূল কাঠামোর কোণগুলোতে কোণিকভাবে প্রসারিত দেওয়াল পাওয়া গেছে।

উদ্ঘাটিত স্থাপত্যকাঠামোর উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব কোণের প্রদক্ষিণ পথের বাইরের দেওয়ালের সাথে মাটির সঙ্গে মিশ্রিত অবস্থায় খাদ্যবস্তু কালো রঙের চালের ডিপোজিট পাওয়া গেছে। এই চালের উপর গবেষণা করলে তৎকালীণ সময়ের ধানের প্রজাতি ও প্রতিবেশের প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। ধারণা করা হচ্ছে, আরো বেশি স্থানজুড়ে খনন কার্যক্রম প্রসারিত হলে এর স্বরুপ ও প্রকৃতির সঠিক অনুমান সম্ভব। প্রাপ্ত নমুনার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার সম্ভব হলে স্থাপত্যকাঠামোসহ প্রত্নবস্তুর সময়কাল, সেখানে বসবাসকারীদের সম্পর্কে বিষদ ধারণা পাওয়া সম্ভব।

সংশ্লিষ্টরা জানান, খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনিতে মধ্য ও আদি-মধ্যযুগর একগুচ্ছ প্রত্নতাত্ত্বিক ঢিবি ও প্রত্নতাত্ত্বিক বিভিন্ন ধরনের নিদর্শন রয়েছে। ইউনিয়নটির কয়েকটি মৌজায় যেমন, কপিলমুনি, রেজাকপুর, রামনগর ও কাশিমনগরসহ বিস্তির্ণ এলাকাজুড়ে প্রতœতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ এখনো টিকে রয়েছে। সাম্প্রতিক মানব বসতির সম্প্রসারণ ও চাষাবাদের ফলে অনেক এলাকার প্রত্নস্থান ও বস্তু বিলুপ্ত হয়েছে। কিংবা বিলুপ্ত হতে চলেছে।

এছাড়া ঔপরিবেশিক শাসনামলের বিভিন্ন জরিপে সংক্ষিপ্তভাবে এখানকার বিভিন্ন প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনের উল্লেখ পাওয়া যায়। এদের মধ্যে জেমস ওয়েস্টল্যান্ড, ও’মাইলি, ডব্লিউ ডক্লিউ হান্টার এর বিভিন্ন জরিপ ও ডিস্ট্রিক গেজেটিয়ারগুলো উল্লেখযোগ্য। এছাড়া সতীশ চন্দ্র মিত্র’র যশোহর ও খুলনার ইতিহাস গ্রন্থে কপিলমুনি-আগ্রার বিভিন্ন প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন ও স্থানের উল্লেখ রয়েছে। সাতক্ষীরার তালা হতে খুলনার পাইকগাছা উপজেলার চাঁদখালী পর্যন্ত (প্রায় ১৪ মাইল) বিস্তৃত এলাকাজুড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ ও তৎকালীণ আগ্রা গ্রামে একটি ঢিবির কথা উল্লেখ করেছেন, আ.ক.ম যাকারিয়া তার বাংলাদেশ প্রত্নসম্পদ বইতে। সতীশ চন্দ্র মিত্র ও আ.ক.ম যাকারিয়া তাদের গ্রন্থে এই এলাকায় পুকুর খননকালে দু’টি বৌদ্ধ প্রতীমা প্রাপ্তির কথা উল্লেখ করেন।

এর আগে গত ১২-১৬ মার্চ ২২’ থেকে খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনি ঢিবি (শিংয়ের বাড়িতে) প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুসন্ধানে আনুষ্ঠানিকভাবে খননকার্যক্রম শুরু করে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর।

সর্বশেষ বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দীর্ঘস্থায়ী খননে উঠে আসতে পারে আদি-মধ্যযুগের মানববসতি স্থাপত্য, উপাসনালয়, তাদের সংষ্কৃতিসহ রহস্যময় প্রতœভান্ডার। প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের পাশাপাশি স্থানয়িরাও চাইছেন, অঞ্চলজুড়ে খননকার্য শুরু করুক সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর।

এরপর জেলা প্রশাসক কপিলমুনিতে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কমপ্লেক্সের নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন, সহচরী বিদ্যা মন্দিও, গদাইপুরের হিতামপুর আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘর ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দকৃত বীরনিবাসের ঘর পরিদর্শন করেন।




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!