খুলনা, বাংলাদেশ | ১৪ চৈত্র, ১৪৩০ | ২৮ মার্চ, ২০২৪

Breaking News

  ময়মনসিংহের ত্রিশালে বাসের ধাক্কায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার তিন যাত্রী নিহত
  সাবেক সংসদ সদস্য ও সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা নজির হোসেন মারা গেছেন
  নওগাঁয় বিএসএফের গুলিতে নিহত বাংলাদেশির মরদেহ ফেরত
  যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত

ক্ষুদিরাম : এক তরুণ বিপ্লবী

ড. বিশ্বম্ভর মন্ডল

বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক থেকে অবিভক্ত ভারতে তখন ব্রিটিশ বিরোধী অহিংস আন্দোলনের পাশাপাশি একটা অন্য ধারার সংগ্রামের ধারণাকে বাস্তবায়িত করার ছোট ছোট প্রয়াস শুরু হয়েছে । সেই সময়ে আফ্রিকাতে অ্যাংলো–বুয়র যুদ্ধ চলছে । বুয়রদের হাতে ইংরেজ সৈন্যদের একেবারে ল্যাজেগোবরে অবস্থা । কারো কারোর মতে বুয়রদের থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই সেই সময়ে এদেশেও গড়ে উঠতে শুরু করেছিল ‘গুপ্ত সংঘ’। এই সংঘের সদস্যদের সংঘের যে কোন আদেশ মানার বাধ্যতামূলক শপথ নিতে হত ।

প্রথম প্রথম গুপ্ত সংঘের সদস্যরা নানা ইস্যুতে ব্রিটিশ বিরোধী জনমত গঠনের কাজ করছিল । ১৯০৩ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব পেশ হবার পর স্বদেশী আন্দোলনকারীরা বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে নানাভাবে প্রতিবাদ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। তা সত্ত্বেও ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব কার্যকর করে। তখন বঙ্গভঙ্গ রদের জন্যে তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে। বিলেতের পণ্য বর্জন, দেশে তৈরি পণ্য ব্যবহার করার আহ্বান জানানো হয় । বিভিন্ন জায়গায় বিলেতের পণ্য পুড়িয়ে দেওয়া শুরু হয়ে যায়। ‘গুপ্ত সংঘ’গুলোর মাধ্যমে বিপ্লবী আন্দোলনে যারা যুক্ত ছিলেন এই সময়ে তাদের সক্রিয়তাও বাড়তে থাকে । ইতিমধ্যেই কিশোর অবস্থাতেই তাঁর সাথে বাংলায় গুপ্ত সংঘের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হেমচন্দ্র কানুনগোর সাথে যোগাযোগ হয়। নিতান্তই অল্প বয়েসে তিনি বিপ্লবী দল যুগান্তরে কর্মী হিসেবে যোগ দেন। বিলেতের পণ্য বর্জন, দেশে তৈরি পণ্য ব্যবহার করার আহ্বান, বিলেতের পণ্য পুড়িয়ে দেওয়ার যে কর্মসূচী চলছিল, পুলিশের চরদের নজর এড়িয়ে তিনি তাতে অচিরেই যুক্ত হয়ে পড়েন ।

১৯০৬ সালে মেদিনীপুরে একটি কৃষি শিল্প প্রদর্শনী চলছে। প্রদর্শনীতে ঢোকার গেটের সামনে ব্রিটিশবিরোধী ‘গুপ্ত সমিতি’র তৈরি ‘সোনার বাংলা’ লিফলেট বিলি করছিলেন। পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গেলেন। এতটুকু ছেলে হলে কি হবে, ওই পরিস্থিতিতেও একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে পুলিশকে হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথের সাহায্যে মেলা প্রাঙ্গণ থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর নামে রাজদ্রোহী মামলা হল। যদিও বিচারে অল্প বয়েস বলে সে মামলায় ছাড় পেয়ে যান।

১৯০৭ সালে হলো বন্যা। এই বন্যায় বিশেষ করে গরীব মানুষদের বিপর্যস্ত অবস্থা সৃষ্টি হল। তিনি বিপ্লবী দলের কর্মী হিসেবে ত্রাণের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। গুপ্ত সমিতি পরিচালনার কাজে এবং ব্রিটিশবিরোধী নানান কর্মসূচী নিতে টাকার প্রয়োজন। স্বাধীনতা সংগ্রামের কাজের জন্যে টাকা সংগ্রহের কাজেও তিনি সামনের সারিতে। এমনকি সরকারের মেল ব্যাগ লুট করে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের কাজে ব্যবহারের জন্যে দলের হাতে টাকা তুলে দিয়েছিলেন। যাকে নিয়ে আলোচনা করছি তিনি ছিলেন দুই বাংলার মানুষের বড় আপনজন । তাঁর নাম ক্ষুদিরাম বোস । জন্ম পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলায় ১৮৮৯ সালে ৩রা ডিসেম্বর ।

ব্রিটিশের বঙ্গভঙ্গের ঘোষণায় বিপ্লবীরাও অ্যাকশনে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল । দেশের বিভিন্ন অংশে বিপ্লবীরা সশস্ত্র হামলা, চোরাগোপ্তা হামলা, পুলিশের সাথে সংঘর্ষ শুরু করে দিয়েছিল। ফৌজদারি আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হলো ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকীর উপর। পরিকল্পনা মতো তারা কিংসফোর্ডের গাড়িতে বোমা ছুড়ে মারলেন । সেদিন কিংসফোর্ডের গাড়িতে কিংসফোর্ড ছিলেন না। ফলে বোমার আঘাতে মারা গেলেন গাড়িতে থাকা অন্য দু’জন মহিলা । পুলিশের হাতে ধরা পড়ার মূহুর্তে গ্রেপ্তার এড়াতে প্রফুল্ল আত্মহত্যা করলেন। ক্ষুদিরাম ধরা পড়েছিলেন ।

বিচারে তার ফাঁসি হয়েছিল – এই ইতিহাস কম বেশি সবারই জানা। গোপন জবানবন্দীতে ক্ষুদিরাম খুনের দায় স্বীকার করে নিয়েছিলেন । উকিলদের সাথে যোগাযোগ হবার পরে তিনি গোপন জবানবন্দীর বয়ান বদল করেন। উকিলরা আদালতকে জানিয়েছিলেন প্রফুল্ল চাকী বোমটা মেরেছে, ক্ষুদিরাম মারে নি, শুধু সাথে ছিল। উকিলদের যুক্তি ছিল- প্রফুল্ল যেহেতু ইতিমধ্যেই প্রয়াত, তাই এই বিবৃতি দিলে নতুন করে কোন ক্ষতি হবে না প্রফুল্লর। উকিলদের সব পরামর্শ মানতে রাজি করানো যায়নি মাত্র ১৮ বছর বয়সের ছেলেটাকে সেদিন, আর আদালতও ছিল একপেশে । তাই হয়তো ফাঁসিটা এড়ানো যায় নি।

গুপ্ত সমিতির নেতৃত্বের চোখে তিনি ছিলেন খুবই বিশ্বস্ত । পুলিশের হাতে ধরা পড়লে শত অত্যাচারেও দেশের বিরুদ্ধে, দলের বিরুদ্ধে তাকে দিয়ে কোন কথা বলানো যাবে না তাকে নিয়ে এই প্রত্যয় তৈরি হয়েছিল। এত অল্প বয়েসে এই মর্যাদা আদায় করা সহজ কথা নয় । তিনি তাঁর জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন, নিজেকে বাঁচানোর থেকে, দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার থেকেও তাঁর অনেক বেশি দায়বদ্ধতা ছিল ব্রিটিশের অত্যাচার থেকে দেশবাসীকে বাঁচানো। এমনটাই ছিল তাঁর আদর্শ, এমনটাই ছিল আদর্শের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা।

বাংলার অনেকেই হয়ত তাঁর আত্মত্যাগকে ভুলে গিয়েছি । ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর লোকের বড় আকাল । ছাত্র অবস্থা থেকেই দেশের কাজে নেমে দেশের জন্যে নিজের জীবন দিয়ে দেবার হিম্মত যারা দেখাতে পারেন তাঁদের মত মানুষদের সব অবদান ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি সমাজে দাপাতে থাকে ধর্মান্ধ ব্যক্তিরা আর সমাজের ও রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় লোভী ব্যবসায়ীদের হাতে । যারা চায় সমাজে ভাইয়ে ভাইয়ে সংঘর্ষের পরিবেশ, নতুন প্রজন্মকে যারা আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর প্রজন্মে পরিণত করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নামই তো ক্ষুদিরাম। স্বাধীনতা আন্দোলনে ব্রিটিশের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সৈনিকদের নামই তো ক্ষুদিরাম। মেরুদন্ডহীন মানুষ, স্তাবক আর মোসাহেবদের ভিড়ে উজ্জ্বল ব্যতিক্রমী আলোর নামই তো ক্ষুদিরাম । লোভী, স্বার্থপর, বিশ্বাসঘাতক, দেশদ্রোহী, ধর্মান্ধ মানুষদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মশাল উঠে আসুক প্রকৃত দেশপ্রেমী মানুষদের হাতে -ক্ষুদিরামের জন্মদিনে এটাই শপথ হয়ে উঠুক দেশে দেশে ।

লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!