খুলনা, বাংলাদেশ | ৬ বৈশাখ, ১৪৩১ | ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Breaking News

  ঢাকা শিশু হাসপাতালে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছে ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট
  রাজধানীর খিলগাঁওয়ে হাত বাঁধা অবস্থায় যুবকের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
  জাতীয় পতাকার নকশাকার, জাসদ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাস মারা গেছেন

কৃষি, শিল্প ও রাষ্ট্র প্রসঙ্গে বিবেকানন্দ

ড. বিশ্বম্ভর মণ্ডল

যদি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি করতে হয় তাহলে কৃষি ও শিল্প দুটোই উন্নতি করা প্রয়োজন এবং দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গেলে সবার আগে দেশের খাদ্যের অভাব দূর করা দরকার-এই ছিল বিবেকানন্দের মত। কৃষি, শিল্প ও রাষ্ট্র বিষয়ে বিবেকানন্দের ভাবনা এই প্রবন্ধের প্রতিপাদ্য ।

কৃষিতে উন্নতি প্রসঙ্গে তাঁর পরামর্শ ছিল – (ক) ছোট ছোট কৃষি জোতে চাষ করা (খ) শ্রম নিবিড় উৎপাদন পদ্ধতি অনুসরণ করা (গ) কৃষি ক্ষেত্রে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত বিদ্যা প্রয়োগ করা (ঘ)সব প্রেসিডেন্সির রাজধানীতে কৃষি সংক্রান্ত বিষয়ে শিক্ষাদান কেন্দ্র খোলা (ঙ)কৃষকদের শিক্ষার জন্য ওয়ার্কসপ করা । তাঁর মত- “নেহাত চাষাড়ে নয়, বিদ্যান বুদ্ধিমানের বুদ্ধিতে চাষ করতে হবে”। জমির ওপর কৃষকের অধিকার নেই বলেই কৃষকরা জমিদার ও মহাজনদের শোষণের শিকার হন – তাই জমির ওপর কৃষকের অধিকার থাকা অত্যন্ত জরুরী বলে তিনি মনে করতেন ।

তাঁর মতে, কৃষিকাজের পাশাপাশি পড়াশোনা করাটা জরুরী । কারণ তাঁর মতে, শিক্ষার অভাব থেকে দারিদ্র বেড়ে যায় । অর্থনৈতিক উন্নতি আনতে গেলে দেশ থেকে দারিদ্র্য দূর করতেই হবে এই ছিল তার মনোভাব। বিশ্বের দারিদ্র বৃদ্ধি হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে তিনি আর্থিক সম্পদের অসম বন্টনকে চিহ্নিত করেছিলেন। এক শিষ্যকে তিনি বলেছিলেন- “শাস্ত্র পড়ে দেখো, জনক ঋষি এক হাতে লাঙ্গল দিচ্ছে্ন, আর এক হাতে বেদ পড়ছেন”। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি তিনি কারিগরি শিক্ষার প্রসারের পক্ষে মত দিয়েছিলেন।

দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর বিশ্লেষণ প্রণিধানযোগ্য- “যাদের হাতে টাকা, তারা রাজ্যশাসন নিজেদের মুঠোর ভেতর রেখেছে, প্রজাদের লুটছে, শুষছে…একথা সত্য যে, কল-কারখানা দ্রব্যাদি সুলভ করেছে, বৈষয়িক উন্নতি ঘটিয়েছে, কিন্তু কেউ ধনী হবার জন্য কেউ লক্ষ লক্ষ লোককে নিষ্পেষিত করবে, দরিদ্ররা আরো দরিদ্র হবে, দলে দলে মানুষ ক্রীতদাসে পরিণত হবে এ জিনিস চলতে পারে না। স্বার্থপরতা ও অহমিকাপূর্ণ বর্তমান ধনিক সভ্যতার ধ্বংস অনিবার্য”(১)। মানুষের অন্ন বস্ত্রের সংস্থান করতে গেলে দেশের সম্পদকে সঠিকভাবে ব্যবহার করার নিশ্চয়তা চাই-এই ছিল তাঁর মত ।

তিনি দেশের হস্তজাত শিল্পের উন্নতি, বড় আয়তনের শিল্পের পাশাপাশি ছোট আয়তনের শিল্পকেও মদত দেয়া, দেশের উৎপাদিত দ্রব্য বিদেশে বিক্রি করার জন্য বিদেশে অ্যাসোসিয়েশন খোলা, গ্রামের কারিগরদের দক্ষতা বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছিলেন। এছাড়াও পাশ্চাত্যের থেকে ভারত প্রযুক্তিবিদ্যার জ্ঞানকে ব্যবহার করুক এটাও চাইতেন । তিনি পাশ্চাত্যের শিল্প বিপ্লবের সুফল যেমন বুঝেছিলেন, একই সাথে শিল্পায়নের ফলে আমেরিকার একচেটিয়া ক্ষমতার সম্প্রসারণ অনুধাবন করেছিলেন । শিল্পক্ষেত্রের মন্দাও তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। এটা যে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বাভাবিক ও অবশ্যম্ভাবী পরিণতি বিবেকানন্দ তা বুঝতে পেরেছিলেন।

একটা দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি কোন্‌ পথে যাবে সেটা নির্ভর করে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কাদের হাতে তার ওপরে । তাঁর মতে রাষ্ট্রের উচিত জনগণের অধিকারকে অগ্রাধিকার দেওয়া। রাষ্ট্রের প্রয়োজন তার প্রজার স্বার্থসাধনের জন্য, শাসকশ্রেণীর স্বার্থ পূরণের জন্য নয়। তিনি গল্প বলার ভঙ্গীতে অর্থনৈতিক জগতের ছবি প্রাঞ্জল ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন- “একদল লোক ভোগের উপযোগী বস্তু তৈয়ার করতে লাগল হাত দিয়ে বা বুদ্ধি করে। একদল লোক সেই ভোগ্য দ্রব্য রক্ষা করতে লাগল। সকলে মিলে সেইসব বিনিময় করতে লাগলো। আর মাঝখান থেকে একদল ওস্তাদ এ জায়গার জিনিসটা ও জায়গায় নিয়ে যাবার বেতনস্বরূপ সমস্ত জিনিসের অধিকাংশ আত্মসাৎ করতে শিখলো।

একজন চাষ করলে, একজন পাহারা দিলে, একজন বয়ে নিয়ে গেল, আরেকজন কিনলে। যে চাষ করলে সে পেলে ঘোড়ার ডিম; যে পাহারা দিলে, সে জুলুম করে কতকটা আগ ভাগ নিলে। অধিকাংশ নিলে ব্যবসাদার, যে বয়ে নিয়ে গেল। যে কিনলে, সে এ সকলের দাম দিয়ে মলো। পাহারাওয়ালার নাম হল রাজা, মুটের নাম হল সওদাগর। এই দু দল কাজ করলে না- ফাঁকি দিয়ে মুড়ো মারতে লাগলো। যে জিনিস তৈরি করতে লাগলো, সে পেটে হাত দিয়ে ‘হা ভগবান’ ডাকতে লাগলো”(২) দেশকে নিয়ে বিবেকানন্দের দূরদৃষ্টি সম্পন্ন স্বপ্ন- “যদি এমন একটি রাষ্ট্র গঠন করতে পারা যায়, যাতে ব্রাহ্মণ যুগের জ্ঞা্ন, ক্ষত্রিয়ের সভ্যতা, বৈশ্যের সম্প্রসারণ শক্তি এবং শূদ্রের সাম্যের আদর্শ এই সবগুলি ঠিক ঠিক বজায় থাকবে অথচ এদের দোষগুলি থাকবে না, তাহলে তা একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে…. প্রথম তিনটির পালা শেষ হয়েছে, এবার শেষটির সময়। শূদ্র যুগ আসবেই আসবে- এ কেউ প্রতিরোধ করতে পারবে না”(৩)। শুদ্রদের প্রতি সমাজে যে অবহেলা সে বিষয়ে তাঁর মূল্যায়নে কোন রাখঢাক নেই। তিনি বলছেন, “যাহাদের শারিরীক পরিশ্রমে ব্রাহ্মণের আধিপত্য, ক্ষত্রিয়ের ঐশ্বর্য, বৈশ্যের ধনধান্য সম্ভব, তাহারা কোথায়? সমাজের যাহারা সর্বাংগ হইয়াও সর্ব দেশে সর্বকালে … ভারবাহী পশু, সে শুদ্রজাতির কি গতি?’’(৪) বৈশ্য শাসন সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “It is awful in its silent crushing and bloodsucking power”।

একথার সাথে আমাদের মনে রাখা দরকার এই প্রসঙ্গে তাঁর বলা আর একটি কথা –“বৈশ্য সভ্যতাই মানুষের ইতিহাসে সবটুকু নয়, তার একটা ধারা হতে পারে-এ বিষয়টি স্বামীজির চোখে ধরা পড়েছিল বলেই বৈশ্য সভ্যতার ভালো দিকটি বলবার সঙ্গে শুদ্র জাগরণের অনিবার্য ভবিষ্যতের প্রতিও ইঙ্গিত দিয়েছেন তাঁর পত্রাবলীতে”(৫) ।

তথ্যসূত্রঃ

(১) বিবেকানন্দ, ‘জনগণের অধিকার’, অখিল ভারত বিবেকানন্দ যুব মহামণ্ডল, খড়দহ, ১৯৭৩, পৃ-৮
(২) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ষষ্ঠ খন্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ২০০৩, পৃ-২০৩-০৪
(৩)বাণী ও রচনা, সপ্তম খন্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ২০০৩, পৃ-৩০১-০২
(৪) বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, স্বামী বিবেকানন্দের সমাজচিন্তার কয়েকটি দিক, ‘স্বামী বিবেকানন্দঃ মার্ক্সবাদীদের দৃষ্টিতে’, এনবিএ, কলকাতা, পৃ-৪২, (৫) তদেব, পৃ-৪২

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!