খুলনা, বাংলাদেশ | ১২ বৈশাখ, ১৪৩১ | ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

Breaking News

  রাঙামাটির সাজেকে শ্রমিকবাহী মিনি ট্রাক পাহাড়ের খাদে পড়ে ৯ জন নিহত

কৃষকের ২৫ টাকার তরমুজ ভোক্তা পর্যায়ে ২০০!

নিজস্ব প্রতিবেদক

আড়তের একপাশে নিশ্চুপ বসা পরশ মন্ডল। অপেক্ষা তরমুজ বিক্রির। খুলনার দাকোপ উপজেলা থেকে ট্রাকে করে খুলনার কদমতলা ফলের আড়তে তরমুজ নিয়ে এসেছেন বিক্রির উদ্দেশ্যে। কিন্তু সকাল গড়িয়ে দুপুর হলেও ক্রেতার দেখা মিলছে না। কখন তরমুজ বিক্রি হবে?  আর বিক্রি হলেও কাঙ্খিত মূল্য পাবে কিনা সেই দুশ্চিন্তায় নিয়ে আড়তে বসে রয়েছেন তিনি। একই অবস্থা অন্য আড়তগুলোতেও। সৈয়দ ভান্ডারে বসে ছিলেন কৃষক অসীত রায় ও সাগর গাইন। তারা দাকোপের কৌলাশগঞ্জ থেকে ট্রাকে করে তরমুজ নিয়ে এসেছেন। অর্ধেকেরও কম তরমুজ বিক্রি করতে পারলেও মেলেনি কাঙ্খিত মূল্য। লাভতো দূরের কথা উঠেনি গাড়ি ভাড়াও। শুধু পরশ, অসীত আর সাগরই নয়, একই অবস্থা খুলনার কদমতলা ফলের বাজারে আসা কৃষকদের। তাদের চোখে-মুখে হতাশার ছাপ।

অথচ খুচরা বাজারে এর ভিন্ন চিত্র। শনিবার রাতে খুলনা মহানগরীর বিভিন্ন বাজারে ভোক্তা পর্যায়ে তরমুজ ২৫ থেকে ৩০ টাকা কেজিতে বিক্রি করতে দেখা গেছে। আড়তে প্রতি পিস তরমুজ কৃষক বিক্রি করছে ২৫ থেকে ৩০ টাকায়। অথচ সেই তরমুজ আড়ৎ ঘুরে খুচরা বাজারে ভোক্তা পর্যায়ে প্রায় ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, খুলনার কদমতলা সর্ববৃহৎ ফলের আড়তে ট্রাক ভরে ভরে তরমিজ আসছে। বাজারে থাকা আড়ৎদারদের প্রতিটি ঘরে তরমুজে সয়লাভ। অনেক চাষী ট্রাক থেকে তরমুজ নামাতে পারছে না বিক্রি না হওয়ায়। ফলে চাষীরা চরম বিপাকে পড়েছে। বিরূপ আবহাওয়া, সঠিক বিপণন ব্যবস্থার অভাব, পরিবহণের সহজলভ্যতা না থাকা এবং একটু দেরিতে তরমুজ তোলার কারণে চাহিদা কমেছে বলে মন্তব্য  করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

দাকোপ উপজেলার খোটাখালী গ্রামের পরশ মন্ডল বলেন, ক্ষেত থেকে তরমুজ কেটে ট্রাকে লোড দিয়ে আড়তে এসেছি লাভের আশায়। কিন্তু এখানে এসে ক্রেতার দেখা পায়নি।

তিনি বলেন, গতবছর ৪ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করে ২ লাখ টাকা কেনা-বেচা করেছিলাম। লাভও হয়েছিলো। লাভের আশায় এবার ৬ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করেছি। ফলনও ভালো হয়েছিল। কিন্তু বাজারে এসে দেখি বাজার খারাপ (দাম কম)। মূল্য কতো কি যে হবে তাও বলতে পারি না।

দাকোপের কৌলাশগঞ্জের কৃষক অসীত রায় বলেন, এবছর প্রথম চার বিঘা জমিতে তরমুজের ক্ষেত করেছি। সবমিলিয়ে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আজ ১ হাজার ৮০০ পিস তরমুজ ২২ হাজার টাকায় ট্রাক ভাড়া করে নিয়ে আসছি। যারমধ্যে ৮৪৫ টা তরমুজ বিক্রি করেছি ২১ হাজার টাকায়। লাভ তো দূরের কথা এখনও ট্রাক ভাড়ায় ওঠেনি। বাকী যে তরমুজ রয়েছে তা বিক্রি হবে কিনা সন্দেহ। আর ক্ষেতে যেটকটু তরমুজ আছে তা আর বাজারে আনবো না, ক্ষেতেই নষ্ট হবে।

তিনি বলেন, খুলনা থেকে আশ্বাস দেয় তরমুজ ভালো দামে বিক্রি হবে, কিন্তু এসে দেখি অর্ধেক দামেও বিক্রি হয় না। ঈদের আগে ভালো দাম ছিল। গতবছর এক লাখ টাকা করে বিঘাপ্রতি তরমুজ বিক্রি করেছি, এবছর ভেবেছি ৫০ হাজার টাকা পাবো। কিন্তু দাম নেই। এই ১৮০০ তরমুজের দাম গতবছর দেড়লাখ টাকা ছিল। লাভ তো দূরের কথা এবার খরচের টাকাও উঠবে না।

একই এলাকার সাগর গাইন বলেন, তরমুজের ক্ষেত করে গত বছর ৩০ হাজার টাকা লাভ করেছিলাম। এবারও লাভের আশায় সমিতি ও ব্যক্তির কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ক্ষেত করেছি। তবে লাভ তো দূরের কথা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এই ঋণ কিভাবে শোধ করবো তা বুঝতে পারছি না। মানসিকভাবে টেনশনে দিন কাটাতে হচ্ছে।

খুলনার কদমতলা ফলের আড়তে তরমুজ কিনতে আসা বগুড়ার নন্দী গ্রামের বাসিন্দা শেখ রতন বলেন, আগে যে তরমুজ ১০-১২ হাজার টাকায় কিনেছি, এখন সেইটা ২ থেকে আড়াই হাজার টাকায় কিনেছি। চাষীর কাছ থেকে প্রতি পিস ৩০ টাকা দরে কিনেছি। আড়ৎদারীসহ বগুড়া নিয়ে যেতে সর্বোচ্চ ৪৫ টাকা পিস পড়বে। এগুলো পাইকারি ৫০ থেকে ৬০ টাকা পিস বিক্রি করবো।

খুলনার কদমতলা ফলের আড়তের সেলসম্যান গৌরঙ্গ কুন্ডু বলেন, বিরূপ আবহাওয়া ও ক্রেতা সংকটের কারণে চাষীরা তরমুজে পয়সা পাচ্ছে না। ফলে ধরা খেয়ে যাচ্ছে মূল উৎপাদনকারী চাষীরা। গাড়ি চালক, লেবার এরা পয়সা কম পাচ্ছে না, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চাষীরা।

তন্ময় ট্রেডার্সের আড়ৎদার এসএম সেলিম বলেন, চাষীরা বর্তমানে বিপদে পড়ে গেছে। ক্ষেতের থেকে মাল তুলে এনে বেচা-কেনা করে গাড়ি ভাড়ার টাকাও রিটার্ণ পাচ্ছে না। এই পরিস্থিতির কারণ হিসেবে তিনি বলেন, তরমুজ একটু দেরি করে পেকেছে। এছাড়া বৃষ্টির কারণে এখন আর মানুষ বেশি তরমুজ খাবে না। এখন বাজারে আম ও লিচু এসে গেছে। এই জন্য তরমুজের চাহিদাও কমে যাবে। বাজারে তরমুজের সরবরাহ অনেক কিন্তু ক্রেতা নেই।

তিনি বলেন, চাষীর মাল বিক্রি করে আমরা কমিশন পাই। চাষীদের মাল আসলে ক্রেতারা আগ্রহ করে কিমতে আসে। কিন্তু সেই মাল কেনার কাস্টমারই নেই মার্কেটে। এই কারণে চাষীরা বিপদে পড়েছে। সকালে ১০০ পিস তরমুজ ২ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি করেছি, যে মাল ঈদের আগে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকায় বিক্রি করেছিলাম। ক্রেতা না থাকার কারণ এই দরপতন বলে জানিয়েছেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, প্রতি পিস ২৫-২৭ টাকা দরে তরমুজ বিক্রি করতে হচ্ছে। এরমধ্যে গাড়ি ও লেবার খরচ দিয়ে প্রতি পিস তরমুজে চাষীরা ৫ থেকে ৭ টাকা করে পাচ্ছে। অথচ ঈদের আগে চাষী ৫০ টাকা থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত পেয়েছে। চাষীদের ব্যাপক টাকা লোকসান গুণতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, এখানে প্রায় ২০০ ঘর রয়েছে। যেখানে ক্রেতা নেই, কিন্তু অসংখ্য তরমুজ পড়ে রয়েছে। বিক্রি না হওয়ায় অনেক তরমুজ নষ্ট হচ্ছে বলে একাধিক আড়ৎদার জানিয়েছেন। সেগুলো ফেলে দিতে হচ্ছে।

খুলনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের তথ্য মতে, এ বছর জেলায় ১৩ হাজার ৯৯০ হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছে।এরমধ্যে দাকোপে ৭ হাজার ৬২৫ হেক্টর, বটিয়াঘাটায় ৩৬০০ হেক্টর, পাইকগাছায় ১৫১০ হেক্টর, কয়রায় ৮৯৫ হেক্টর, ডুমুরিয়ায় ৩৫০ হেক্টর, রূপসায় ৫ হেক্টরে, তেরখাদায় ৩ হেকটর ও ফুলতলা উপজেলায় এক এবং মেট্রো থানায় এক হেক্টর জমিতে তরমুজের চাষ হয়েছে।

খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো: হাফিজুর রহমান  বলেন, খুলনায় এবার তরমুজের ব্যাপক আবাদ হয়েছে। গত বছরের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ জমিতে তরমুজের চাষ হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে চাষীরা তরমুজের ভালো দাম পেয়েছে। কিন্তু বর্তমানে তরমুজের দাম কিছুটা কম।

দরপতনের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, তরমুজ একমাস পিছিয়ে লাগাতে বলা হয়েছিল, কিন্তু অনেক জায়গাতে ধান কাটার পর কিছুটা দেরিতে তরমুজের আবাদ করা হয়েছে। যে কারণে তরমুজ দেরিতে পেকেছে। এছাড়া তরমুজ আগে ফোড়িয়ারা এসে কিনে নিয়ে যেতো। কিন্তু সঠিক বিপনণ ব্যস্থার অভাবের কারণে তরমুজের বিক্রি কমেছে। আর গাড়ি ভাড়াও অনেক। গাড়ি ভাড়ার সহজলভ্যতার ও সঠিক বিপনণের ব্যবস্থা করা হলে চাষীরা উপকৃত হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!