খুলনা, বাংলাদেশ | ১১ বৈশাখ, ১৪৩১ | ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

Breaking News

  ৬ দিনের সফরে আজ থাইল্যান্ড যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী

করোনাকালে চেম্বারকথন

ডা. শেখ সাদিয়া মনোয়ারা ঊষা

চেম্বার থেকে ম্যানেজার সাহেবের ফোন .
ইমারজেন্সি রোগী ..

সারাদিন পর বাসায় ঢোকার সাথে সাথে ফোন।
ভালোলাগা ও খারাপলাগার মাঝামাঝি একটি মিশ্র অনুভূতি হল।
বাসা থেকে চেম্বার বেশ দূরে।
লকডাউনে আরো বেশি কষ্ট।
অন্য দিনের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ দেরিতে পৌঁছালাম আজ।

মোটামুটি সময়নিষ্ঠ আমি এতে বেশ লজ্জিত হলাম।
দ্বিগুণ দেরীকে পুষিয়ে দিতে দ্বিগুণ আন্তরিকতায় রোগী দেখা শুরু করলাম।

রোগীর বয়স ১৮ বছর। গর্ভবতী।
এসেছেন বটিয়াঘাটা উপজেলা থেকে।
সাথে এসেছে রোগীর মা এবং শাশুড়ি।
তিনজনই বোরকা পরিহিতা। মাস্ক বিহীন।
বোরকার সিন্থেটিক কাপড়ের একটি অংশ সুকৌশলে নাকের নিচে সেটে মাস্কের মতো পরে আছেন।

তাদেরকে মাস্ক পরতে বলা হলে তন্নতন্ন করে ভ্যানিটি ব্যাগ খুঁজলেন। আয়না, চার্জার, চিরুনি,চাবি সব খুঁজে পেলেন। কিন্তু মনে হল কোন রত্নভাণ্ডারের খনিতে মাস্ক নামক রত্নটি হারিয়ে গেছে এবং তা উদ্ধারে কোন বাহিনীর সাহায্য লাগতে পারে।
চেম্বার থেকে তিনটি মাস্ক তাদেরকে গিফট করা হলো।

আমি একজনকে রোগীর সাথে থাকার জন্য অনুমতি দিলাম।কিন্তু একজন বেয়ান আর একজনকে ছেড়ে কিছুতেই যাবেন না। কোন মহিলার মা এবং শাশুড়ির মধ্যে এই ধরনের মিল দেখে আমার ভালই লাগলো।

একটু পরেই বুঝলাম কারণ।
রোগী কোন কথা বলে না। খুবই চুপচাপ।
এখানে রোগীর মা এবং শাশুড়ি দুজন দু ভূমিকায় রয়েছেন।
একজন রোগীর শরীরের সমস্যা বলছেন, তিনি রোগীর মা। অন্যজন এই পর্যন্ত কি কি চিকিৎসা করা হয়েছে সে কথা বলছেন, তিনি রোগীর শাশুড়ি।
অর্থাৎ রোগীর রোগের ইতিহাস জানতে দু’জনকেই আমার চেম্বারে জায়গা দিতে হলো।

আশ্চর্যজনক হলেও দুজন মিলে রোগী কত মাসের গর্ভবতী তা সঠিক বলতে পারলেন না। এই পর্যন্ত কোন পরীক্ষা করানো হয়নি ‌। আয়রন ক্যালসিয়াম কিছু খাওয়ানো হয়নি ‌।
এমনকি রোগীর রক্তের গ্রুপটা পর্যন্ত জানেন না।

যাহোক, রোগীর মূল সমস্যা তার বাচ্চা নড়াচড়া করছে না।
ভাবলাম‌ আগে বাচ্চার নড়াচড়াটা পরীক্ষা করে নেই।

বাচ্চার হার্টবিট ভালো ছিল।
আমিও একটু স্বস্তি পেলাম।

রোগী শাশুড়ি বললেন পেট শক্ত হয়ে যাচ্ছে এজন্য তারা ভয় পেয়ে গেছেন। আমি পুরো প্রেসক্রিপশন করে দিলাম। কি কি টেস্ট করতে হবে বলে দিলাম। বাঁকাতে শোয়া থেকে শুরু করে নানা বিষয় বুঝিয়ে দিয়ে যখন ওষুধের কথা বললাম তখন বললেন এই ওষুধগুলো দুপুরেই খেয়েছেন।

বললাম কার প্রেসক্রিপশনে খেয়েছেন? এইমাত্র তো বললেন এর আগে কোন ডাক্তারকে দেখানো হয়নি!!

বললেন বটিয়াঘাটা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দেখিয়েছেন।
প্রেসক্রিপশন দেখতে চাইলাম।
মা শাশুড়ি দুইজন দুই চোখের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছেন।সত্যি বলছি দুই বিয়ানের এর ভিতর যে মিল তা চোখে পড়ার মতো।

আমি বললাম দেখুন প্রেসক্রিপশন দেখলে একটা সুবিধা হবে আমার ওষুধের সাথে অনেক কিছু মিলে যেতে পারে, সে ক্ষেত্রে সেটি আপনার কেনা লাগবেনা।

কি একটা মনে করে রোগীর মা ছিটকে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। হাওয়ার গতিতে এসে বটিয়াঘাটায় হেলথ কমপ্লেক্স এর একটি ছোট্ট চিকিৎসাপত্র আমার হাতে দিলেন।

আসলেই কয়েকটি ওষুধ মিলে গেল।
প্রেসক্রিপশন ফিরিয়ে দিতে দিতে হঠাৎ নিচে এক কোনায় দেখলাম এন্টিজেন টেস্ট লেখা।
আমি বললাম অ্যান্টিজেন টেস্টের কথা লেখা আছে যে?
জ্বর ছিল নাকি? বা কোন সর্দি কাশি গলাব্যথা?
কারণ আমি পরীক্ষা যখন করেছি তখন উচ্চ তাপমাত্রা ছিল না।
তথ্য দিলেন, তিনদিন আগে একটু এরকম হয়েছিল । তেমন না ।

ডেল্টা ডেল্টা গন্ধ পাচ্ছি!!
বললাম আগামীকালই দ্রুত টেস্ট করে ফেলতে।
রোগীর শাশুড়ি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা টেস্ট করে যদি পজিটিভ হয় ,কেউ তো আমার বউ মারে নিবেনা।’

আমি বুঝিয়ে বললাম ‘পজিটিভ রোগী গর্ভবতী থাকলে তার জন্য সুব্যবস্থা রয়েছে। এখন পজেটিভ রোগীর প্রতি সবাই সহনশীল।’

তখন শাশুড়ি খপ করে আমার হাত ধরে ফেললেন।
বললেন ‘মা তোমার মত কেউ বলে নাই তাই, তোমারে এই প্রথম বলতেছি। ওই টেস্টটা সকালেই বটিয়াঘাটায় করছি।
কইছে পজিটিভ আইছে। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি না। মাইয়ার কোন দোষ নাই।তাই এখানে নিয়াইছি‼️

হতবাক বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়ে গেলাম।
করোনা পজিটিভ রোগী এখনও নির্বিকার ভাবে আমার সামনে বসা। যার নিজের নড়াচড়া সম্পর্কে জ্ঞান নেই ,বাচ্চার নড়াচড়া সে আদৌ বোঝে কিনা বুঝতে পারলাম না।
তার শাশুড়ি আমার হাত ধরা।
তার মা দূরে দাঁড়িয়ে এখনো নাকের নিচে মাস্ক নিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে আমার অনুভূতি বুঝার চেষ্টা করছেন।

মনে করার চেষ্টা করলাম ,পেটে স্টেথেস্কোপ লাগিয়ে বাচ্চার হার্টবিট শোনার সময় রোগীর কতটা কাছে ছিলাম!

মুখে দুইখানা মাস্ক, ২ডোজ এস্ট্রোজেনিকা ভ্যাকসিন, একবার কোভিড আক্রান্ত হওয়া শরীর ডেল্টা ভেরিয়েন্ট এর বিরুদ্ধে কতটুকু লড়াই করতে পারে আজ তার পরীক্ষা।

সে পরীক্ষায় কে জিতেছে জানিনা!!
জানবার জন্য অপেক্ষা করতে হবে …

কিন্তু আমার ঘুম হচ্ছে না !!!!
চিন্তা হচ্ছে ।নিজের জন্য নয়।

একটু ঘুম আসছে আর মনে হচ্ছে, এভাবে গোপন করলো? বটিয়াঘাটা থেকে এ পর্যন্ত আসতে কতজনকে ছড়িয়েছে? ক্লিনিকে এসে কতজনকে ছড়ালো? এই রোগীকে আমি আল্ট্রাসনোগ্রাম , রক্তের গ্রুপ করতে যেখানে পাঠাচ্ছিলাম ,সেখানে কতজনকে ছড়াতো ?
যে লাইনে দাঁড়িয়ে টেস্ট করেছে সেখানে বহুবার নিষেধ করা সত্ত্বেও সবাই গাদাগাদি করে দাঁড়ায়, সেখানে কতজন তার দ্বারা আক্রান্ত হল? এই দুই বেয়ান তার সাথে সকাল থেকে আঠার মতো লেগে আছে ,এদের ভবিষ্যৎ কি ও বাহক হয়ে এরা কয়জনকে আক্রান্ত করবে? ………

ঘুম আসছে না..
কিছুতেই না…

ওহ, ছবি আঁকা কেমন হলো??🙂 তথ্য সূত্রঃ লেখকের ফেসবুক ওয়াল থেকে সংগৃহীত।

(লেখকঃ মেডিকেল অফিসার রোগ নিয়ন্ত্রণ, সিভিল সার্জন অফিস, খুলনা।)

খুলনা গেজেট/এমএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!