খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ বৈশাখ, ১৪৩১ | ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Breaking News

  চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নতুন সভাপতি মিশা, সাধারণ সম্পাদক ডিপজল

কমরেড অবণী বিশ্বাস – এ কেমন চলে যাওয়া

অ্যাড. মোঃ বাবুল হাওলাদার

চীনা সাহিত্যিক সিমা সিয়েন বলেছেন, ‘মানুষের মৃত্যু অনিবার্য, কিন্তু তার তাৎপর্য হবে থাই পাহাড়ের চেয়েও ভারি বা বেলে হাঁসের পালকের চেয়ে হালকা।’ কমরেড অবণী বিশ্বাসের মৃত্যু তাঁর সহযোদ্ধা স্বজনদের কাছে তেমনি থাই পাহাড়ের চেয়েও ভারি।

সদা হাস্যোজ্জ্বল, সদালাপী কমরেড অবণী বিশ্বাস নব্বই পরবর্তী সময়ে ছাত্র ইউনিয়নে কাজ করার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে যুক্ত হন। বিএল কলেজের ছাত্র থাকায় বিএল ছাত্র ইউনিয়নের সাথেই প্রথম দিকে বেশী কাজ করেন। নগরীর দোলখোলায় বসবাস করার সুবাদে পরবর্তীতে শহরের সাংগঠনিক কাজের সাথেও যুক্ত হন। দু’জায়গাতেই সমান তালে চলে তাঁর সাংগঠনিক কর্মকা-। ছাত্র রাজনীতির শেষের দিকে ব্যক্তিগত কারণে কিছুদিন রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলেও পরবর্তীতে তিনি সিপিবি’র কাজের সাথে যুক্ত হন নতুন উদ্যোমে। পার্টির প্রতি ভালোবাসা, পার্টির শৃঙ্খলা ও নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য, ক্লান্তিহীনভাবে পার্টির কাজের সাথে যুক্ত থাকা প্রভৃতি কারণে তিনি অল্প সময়েই পার্টির নেতা হয়ে ওঠেন। খুলনা নগর পার্টির সম্পাদকম-লীর সদস্য ও ২৪ নং ওয়ার্ড শাখার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন দক্ষতা ও আন্তরিকতার সাথে। সাম্প্রতিক সময়ে পেশাগত ও পারিবারিক ব্যস্ততার কারণে পার্টিতে ধারাবাহিক সময় না দিতে পারলেও যেকোনো সংকটময় মুহূর্তে তাঁর উপস্থিতি ও ভূমিকা ছিল সাংঘাতিক দায়িত্বশীল।

কমরেড অবণী বিশ্বাসের সাথে আমার পরিচয় হয় ছাত্র ইউনিয়ন করার সুবাদে ১৯৯৬ সালের কোনো এক সময়ে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাজপথে মিছিল করতে করতে আমাদের সম্পর্ক পরিণত হয় বন্ধুত্বে। তারপর অনেক পথ চলা। পার্টির যেকোনো দুঃসময়ে অবণী বিশ্বাসের নামটি মনে পড়তো সবার আগে। নেতৃত্ব যেকোনো দায়িত্ব দিলে না বলতে শুনিনি কখনও। বছর দুয়েক আগে স্ট্রোক করে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। পার্টিতে সময় দিতে না পারার কারণে তাঁর আফসোসের সীমা ছিল না। অনেক স্বপ্ন ও পরিকল্পনা ছিল পার্টি নিয়ে। সর্বশেষ মৃত্যুর ৩/৪ দিন আগে তাঁর এক আত্মীয়ের মাধ্যমে তাঁর অসুস্থতার খবর পাই এবং জানতে পারি যে তিনি জ্বরে আক্রান্ত। করোনা টেস্টে রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। কিন্তু টাইফয়েড ধরা পড়েছে। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে বাসায় চিকিৎসাধীন আছেন। দেখতে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও বিদ্যমান বাস্তবতায় তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। বৃহস্পতিবার আমার শারীরিক অবস্থা কিছুটা খারাপ থাকার কারণে বাসায় বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। রাত ৮টার দিকে পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য কমরেড এস এ রশীদের ফোন। রিসিভ করতেই ফোনের অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসলো, অবণী নাকি মারা গেছে তুমি কিছু জানো ? আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, ভুল শুনছি। পুনরায় জানতে চাইলাম, রশীদ ভাই রিপিট করলেন। তাঁকে বললাম, আমি তো জানিনা, দেখছি। অবশ হয়ে গেল আমার সারা শরীর। মাথায় কোনো কাজ করছিল না। হাত-পা কাপছে। কিছুক্ষণের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। খানিকক্ষণ বাদে মনে পড়লো অবণী বিশ্বাসের এক নিকটজনের কথা। ফোন করে জানতে চাইলে তিনিও কিছু জানেন না বলে জানান। ফোন রাখতেই রশীদ ভাইয়ের পুনরায় ফোন, অনাকাক্সিক্ষত সংবাদটি নিশ্চিত করলেন। মুহূর্তের মধ্যে চোখের সামনে ভেসে উঠলো অজ¯্র স্মৃতি। নিজের অজান্তেই চোখের কোণ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরছে।

১৯৯৬ থেকে ২০২১ সময়ের বিবেচনায় নেহাত কম নয়। অবণী বিশ্বাস ব্যক্তিগত ও পারিবারিক শত সংকটের মধ্যেও তাঁর স্বপ্ন বেঁচে দেননি এক মুহূর্তের জন্যও। অবণী বিশ্বাস এবং আমাদের স্বপ্ন এক ও অভিন্ন। ছাত্র রাজনীতি করার সময় যে-অজ¯্র সহযোদ্ধা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মিছিল করেছি একসাথে। তাঁদের অনেকেই বাস্তবতার কষাঘাতে আমাদের সেই মিছিলের কাফেলায় আজ আর নেই। কিন্তু শত সংকটের মাঝেও সমসাময়িক গুটি কয়েক বন্ধু লাল স্বপ্ন বুননের কাজে নিজেকে ন্যস্ত করেছিলেন কমরেড অবণী বিশ্বাস তাদের মধ্যে অন্যতম। সুদর্শন, স্মার্ট, টগবগে এ মানুষটি আর যাই হোক চিরতরে চলে যাওয়াটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যই বলতে হবে। যেমনটি তাঁর মমতাময়ী স্ত্রী এবং পরিবারের অন্যদের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য।

কমরেড অবণী বিশ্বাস, বড় অকালে তোমার এ চলে যাওয়া আমাদের ব্যথিত করেছে। জানিনা কেন এমন অভিমান করলে আমাদের উপর। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তুমি চলে গেলে না ফেরার দেশে। যেখান থেকে কেউ কখনও ফেরে না। জানিনা তোমার দেখা স্বপ্ন শোষণহীন সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠায় কতটা করতে পারবো আমরা। তবে কথা দিচ্ছি, তোমার হাতে উড্ডীন রাখা লাল পতাকা অধঃনমিত হতে দেবো না শরীরের শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত। তোমার স্বপ্ন, রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে পিছপা হবো না একবিন্দুও। ঘুমাও অবণী বিশ্বাস, ঘুমাও। কমরেড লাল সালাম।

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, সিপিবি, খুলনা মহানগর।




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!