খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ বৈশাখ, ১৪৩১ | ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Breaking News

  যশোরে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২.৬ ডিগ্রি, খুলনায় ৪১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে
  চুয়াডাঙ্গায় হিট স্ট্রোকে প্রাণ গেল ১ জনের
  দাবদহের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়ল ৫ দিন, খুলবে ২৮ এপ্রিল

কপিলমুনির বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে প্রাচীন মানব বসতি, ধর্মীয় স্থাপত্য ও প্রত্নবস্তু উদ্ধার

শেখ নাদীর শাহ্,পাইকগাছা

খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনিতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খননে একের পর এক উঠে আসছে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপত্যকাঠামো ও প্রাচীন আমলের নানা প্রত্নবস্তু। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দাবি, স্থাপনাগুলো নবম থেকে দ্বাদশ শতকের। পর্যায়ক্রমে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ঢিবিগুলো খননে প্রাপ্ত নমুনার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় উঠে আসতে পারে সুনির্দিষ্ট শাসনামলের সময়কাল, প্রাচীন স্থাপত্যশৈলী এবং সেখানে বসবাসকারীদের সম্পর্কে বিষদ ধারণা। স্থানীয়রা বলছেন, আশপাশের কয়েকটি গ্রামজুড়ে রয়েছে এমন অনেক পুরনো ঢিবি।

মাত্র এক মাস বরাদ্দের খননে খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনি ইউনিয়নের রেজাকপুর শিংয়েরবাড়ি ঢিবিতে খুলনা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খননে দৃশ্যমান নবম হতে দ্বাদশ শতকের স্থাপত্যকাঠামো। ইতোমধ্যে সেখানকার পাওয়াগেছে, প্রাচীণ আমলের বিভিন্ন ধরনের মৃৎপাত্র, মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ, পোড়া মাটির ফলক, প্রতীমার ভগ্নাংশ, অলংকৃত ইট, বিনিময় মাধ্যম কড়িসহ বিভিন্ন ধরনের প্রত্নবস্তু।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খননের সফলতা নীরিক্ষণপূর্বক পরিদর্শনে গত ২৩ এপ্রিল অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রতন চন্দ্র পন্ডিত খননস্থল পরিদর্শন করেছেন। এসময় অধিদপ্তরের উপরিচালক (প্রশাসন) মাইনুর রহিম, উপপরিচালক (প্রত্ন.) ড. মো. আমিরুজ্জামান, আঞ্চলিক পরিচালকের কার্যালয়, খুলনার আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা, কাস্টোডিয়ান বাগেরহাট মোহাম্মদ যায়েদ, ফিল্ড অফিসার মো. আল আমীনসহ খনন টিমের সদস্যবৃন্দ, খনন শ্রমিকগণ ও স্থানীয় ভূমি মালিকগণ উপস্থিত ছিলেন। এয়াড়া প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সুন্দরবনে জরিপ ও মিডিয়ায় সাম্প্রতিক বিভিন্ন কার্যক্রম দেখে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়ে পরিদর্শনে আসেন, সুন্দরবনের flora, fauna, সুন্দরবনের প্রাচীন মানববসতির লবণ তৈরির পাত্র ও চুল্লি নিয়ে কাজ করা জার্মান গবেষক Dr. Gertrud Neumann-Denzau. এসময় তাঁর গবেষণা ও খুলনা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের বিভিন্ন কাজের বিষয়ে আলোচনা হয়। এসময় তাঁর সাথে ছিলেন, এই অঞ্চলের পর্যটন নিয়ে নিরলস কর্মী নজরুল ইসলাম বাচ্চু।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা বলেন, কপিলমুনিস্থ সিংয়ের বাড়ি ঢিবি খননে দৃশ্যমান স্থাপত্যকাঠামোর দৈর্ঘ্য আনুমানিক ২৫০ মিটার ও প্রস্থ ১৮০ মিটার। ঢিবির দক্ষিণাংশ খননে একটি বর্গাকার স্থাপত্যকাঠামো স্পষ্ট। যেখানে একটি বর্গাকার কক্ষ উঠে এসেছে। কক্ষটিকে ঘিরে দেওয়াল দিয়ে বেষ্ঠিত একটি প্রদক্ষিণ পথ রয়েছে। মূল কাঠামোর কোণগুলোতে কোণিকভাবে প্রসারিত দেওয়াল পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, আরো বেশি স্থানজুড়ে খনন কার্যক্রম প্রসারিত হলে এর স্বরুপ ও প্রকৃতির সঠিক অনুমান সম্ভব।

কাস্টোডিয়ান বাগেরহাট ও উক্ত খননকাজের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ যায়েদ জানান, উদ্ঘাটিত স্থাপত্যকাঠামোর উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব কোণের প্রদক্ষিণ পথের বাইরের দেওয়ালের সাথে মাটির সঙ্গে মিশ্রিত অবস্থায় খাদ্যবস্তু কালো রঙের চালের ডিপোজিট পাওয়া গেছে। এই চালের উপর গবেষণা করলে তৎকালীণ সময়ের ধানের প্রজাতি ও প্রতিবেশের প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সমূহের সময়কাল খ্রি. নবম হতে দ্বাদশ শতক। তবে বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে বিস্তারিত খননকাজ পরিচালনা ও প্রাপ্ত নমুনার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার সম্ভব হলে স্থাপত্যকাঠামোসহ প্রত্নবস্তুর সময়কাল, সেখানে বসবাসকারীদের সম্পর্কে বিষদ ধারণা পাওয়া সম্ভব।

খনন কার্যক্রমের প্রথম দিকে স্থাপত্যকাঠামো দেখে সেটি প্রাচীন বৌদ্ধ আমলের নিদর্শন বলে ধারণা করা হলেও পর্যায়ক্রমে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তু দেখে এর সঠিক সময়কাল সম্পর্কে এখনি বলা মুশকিল। তবে এটি কোন ধর্মীয় উপাসনালয় বলে ধারণা করা হলেও ঠিক কোন সময়ের তা বলা যাচ্ছেনা। বিশেষ করে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তু প্রতিদিন নতুন নতুন তথ্য ও ধারণায় বদল ঘটাচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনিতে মধ্য ও আদি-মধ্যযুগর একগুচ্ছ প্রত্নতাত্ত্বিক ঢিবি ও প্রত্নতাত্ত্বিক বিভিন্ন ধরনের নিদর্শন রয়েছে। ইউনিয়নটির কয়েকটি মৌজায় যেমন, কপিলমুনি, রেজাকপুর, রামনগর ও কাশিমনগরসহ বিস্তির্ণ এলাকাজুড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ এখনো টিকে রয়েছে। সাম্প্রতিক মানব বসতির সম্প্রসারণ ও চাষাবাদের ফলে অনেক এলাকার প্রত্নস্থান ও বস্তু বিলুপ্ত হয়েছে। কিংবা বিলুপ্ত হতে চলেছে।

ঔপরিবেশিক শাসনামলের বিভিন্ন জরিপে সংক্ষিপ্তভাবে এখানকার বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের উল্লেখ পাওয়া যায়। এদের মধ্যে জেমস ওয়েস্টল্যান্ড, ও’মাইলি, ডব্লিউ ডক্লিউ হান্টার এর বিভিন্ন জরিপ ও ডিস্ট্রিক গেজেটিয়ারগুলো উল্লেখযোগ্য।

এছাড়া সতীশ চন্দ্র মিত্র’র যশোহর ও খুলনার ইতিহাস গ্রন্থে কপিলমুনি-আগ্রার বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও স্থানের উলে¬খ রয়েছে। সাতক্ষীরার তালা হতে খুলনার পাইকগাছা উপজেলার চাঁদখালী পর্যন্ত (প্রায় ১৪ মাইল) বিস্তৃত এলাকাজুড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ ও তৎকালীণ আগ্রা গ্রামে একটি ঢিবির কথা উল্লেখ করেছেন, আ.ক.ম যাকারিয়া তার বাংলাদেশ প্রত্নসম্পদ বইতে। সতীশ চন্দ্র মিত্র ও আ.ক.ম যাকারিয়া তাদের গ্রন্থে এই এলাকায় পুকুর খননকালে দু’টি বৌদ্ধ প্রতীমা পাওয়া গিয়েছিল বলে উল্লেখ করেন।

সম্প্রতি কপিলমুনি এলাকায় প্রাথমিক জরিপকালে খুলনা ও বরিশাল বিভাগের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ দল বেশ কয়েকটি প্রত্নস্থান শনাক্ত করেছেন। বিশেষ করে কপিলমুনি বাজারের একটি মন্দিরে পূজিত বিষ্ণু প্রতিমাটি আনুমানিক খ্রি.৭ম-৮ম শতাব্দির বলে অনুমান করা হয়। সর্বশেষ খননকাজে প্রত্নবস্তু বিশেষ করে মৃৎপাত্রের শ্রেণিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ও সময়কালের উপর ভিত্তি করে প্রত্নস্থানগুলো আদি মধ্য যুগের (আনুমানিক নবম হতে দ্বাদশ শতক) বলে প্রাথমিকভাবে অনুমান করা যায়।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা আরো জানান, পুরো এলাকার স্থাপনাগুলি দীর্ঘ দিন পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকার পর পরবর্তী পর্যায়ে ক্রমান্বয়ে এলাকাবাসী বিক্ষিপ্তভাবে (অপরিকল্পিত উপায়ে) এখানকার ইট উঠিয়ে আধুনিক স্থাপনাসমূহে এর ব্যবহার শুর” করে। এসব খননে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের ইট, মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ, প্রাণীর হাঁড় উঠে আসে। সর্বশেষ প্রাচীনকালে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুসন্ধানে ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে পাইকগাছা উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় জরিপ ও অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালিত হয়। জরিপ শেষে শনাক্তকৃত উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য ঢিবিগুলোর মধ্যে শিংয়ের বাড়ি রেজাকপুর কপিলমুনি ঢিবিটিকে নির্বাচন করা হয়েছে।

এর আগে গত ১২-১৬ মার্চ ২২’ থেকে খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনি ঢিবি (শিংয়ের বাড়িতে) প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুসন্ধানে আনুষ্ঠানিকভাবে খননকার্যক্রম শুর করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। তিনি আরো জানান, তাদের টিমে ৪ জন কর্মকর্তা, ৫ জন বিভিন্ন গ্রেডের কর্মচারী, বগুড়ার মহাস্থানগড়ের ২ জন দক্ষ খনন শ্রমিক, বাগেরহাটের ৪ জন খনন শ্রমিক ও স্থানীয় ১০ জন শ্রমিক রয়েছেন।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও সরকারের অতিরিক্ত সচিব রতন চন্দ্র পন্ডিত’র সার্বিক নির্দেশনায় পরিচালিত প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্ত হিসেবে রয়েছেন, বাগেরহাট যাদুঘরের কস্টোডিয়ান মো.যায়েদ। দীর্ঘ দিনের এই অঞ্চলে কাজের অভিজ্ঞতা থাকায় খননকাজে পরামর্শ প্রদান করছেন, সিলেট ও চট্টগ্রামের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক একেএম সাইফুর রহমান। এছাড়া পরামর্শক হিসেবে যুক্ত রয়েছেন, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক স্বাধীন সেন।

সর্বশেষ বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দীর্ঘস্থায়ী খননে উঠে আসতে পারে আদি-মধ্যযুগের মানববসতি স্থাপত্য, উপাসনালয়সহ তাদের সংষ্কৃতিসহ রহস্যময় প্রত্নভান্ডার। আর এজন্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পাশাপাশি এলাকাবাসীও চাইছেন, অঞ্চলজুড়ে খননকার্য শুরু করুক সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর। এজন্য তারা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!