খুলনা, বাংলাদেশ | ১৫ চৈত্র, ১৪৩০ | ২৯ মার্চ, ২০২৪

Breaking News

  দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে খাদে পড়ে বাসে আগুন, নিহত ৪৫
  গাজীপুরের কাপাসিয়ায় গরু চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত ২
৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

আদর্শ শিক্ষক অধ্যাপক আবদুল কাদির ভূঁইয়া

ড. খ. ম. রেজাউল করিম

৩০ মে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মাদ আবদুল কাদির ভূঁইয়ার ৩য় মৃত্যুবার্ষিকী। কর্মযোগী, আদর্শ ও শিক্ষার্থী-বান্ধব শিক্ষক হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক ভূঁইয়া ২০২০ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মে ডেংগু জ্বর আক্রান্ত হয়ে ঢাকাস্থ মেরুল বাড্ডার নিজ ফ্লাটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

অধ্যাপক আবদুল কাদির ভূঁইয়া ছিলেন দেশের একজন প্রথিতযশা শিক্ষক ও সমাজবিজ্ঞানী। তিনি ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করে ১৯৬৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। পরের বছর সমাজবিজ্ঞান একটি স্বতন্ত্র বিভাগ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি সেখানে যোগ দেন। তিনি ১৯৭৯ সালে দিল্লী স্কুল অব ইকোনোমিক্স (ভারত) থেকে পিএইচ-ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি দীর্ঘ প্রায় ৪৪ বছর সমাজবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতা করেন। শুরু থেকেই বিভাগটির নানামুখী উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের সাথে তিনি জড়িত ছিলেন। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৩ সাল অবধি তিনি বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট, সিনেট, একাডেমিক কাউন্সিল এবং ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ-এর বোর্ড অব গভর্নেন্স এর সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৭ সাল অবধি শের-এ বাংলা হলের প্রাধ্যক্ষ ও ১৯৯৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান এবং ২০০৫ সাল পর্যন্ত সেখানে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০১২ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণের পর তিনি ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল অবধি খাজা ইউনুস আলী ইউনিভার্সিটি, সিরাজগঞ্জ-এ উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ইন্ডিয়ান সোসিওলজিক্যাল সোসাইটি, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ ও বাংলা একাডেমী’র জীবন সদস্য এবং আমেরিকান সোসিওলজিক্যাল এসোসিয়েশন-এর সদস্য ছিলেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন আমি অধ্যাপক ভূঁইয়াকে আমার শিক্ষক রূপে পাই। প্রথমত সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হিসেবে এবং পরবর্তীকালে ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ-এর ফেলো হিসেবে আমি তাঁর তত্ত্বাবধানে পিএইচ-ডি গবেষণা সম্পন্ন করি। সেই সুবাদে অধ্যাপক ভূঁইয়ার সাথে আমার সম্পর্ক ছিল দীর্ঘ প্রায় ২৭ বছরের। তাঁর বেশ কিছু গবেষণা কাজে সহযোগী হিসেবে কাজ করা ও সহযাত্রী হিসেবে দেশের নানা স্থানে ভ্রমণের কারণে তাঁর কাছাকাছি যাবার সুযোগ ঘটে। অধ্যাপক ভূঁইয়ার জীবনযাপন ও সামাজিক যোগাযোগ রক্ষার ধরন, তাঁর চিন্তা জগতের ব্যাপ্তি এবং সততা, সময়ানুবর্তিতা ও পরোপকারী স্বভাবের কারণে তিনি আমার কাছে একজন অনুকরণীয় আদর্শ শিক্ষক ছিলেন।

কর্মজীবনে ভূঁইয়া স্যার ছিলেন একজন সৎ, সফল, শিক্ষার্থীবান্ধব জনপ্রিয় শিক্ষক। একজন আদর্শ শিক্ষকের যেসব বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার তাঁর সেসব বৈশিষ্ট্যর বাইরে এমন কিছু গুণ ছিল, যা তাকে শিক্ষার্থীদেরকে কোনোদিন ভুলতে দেয়নি। অনার্স ৩য় বর্ষে পড়াকালীন পরিচয় হলেও স্যারকে আমি মাস্টার্স শেষ পর্বের আধুনিক সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্বের কোর্স শিক্ষক হিসাবে পাই। স্যারের পড়ানোর কৌশল, উপস্থাপনভঙ্গি ও ভাষা ছিল সাবলীল। তত্ত্বের মতো রসকষহীন কঠিন বিষয়কে তিনি সহজ ও আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করতে পারতেন। তিনি ঘড়ির কাঁটা মেপে প্রতিদিন সকাল ৮.১৫ মিনিটে ক্লাসে হাজির হতেন। কোনো দিন এর ব্যতিক্রম চোখে পড়েনি। ক্লাসে ঢুকেই কোনো রকমে শিক্ষার্থীদের হাজিরা স¤পন্ন করেই তিনি তার প্রস্তুতকৃত কাঠামোবদ্ধ বক্তৃতা শুরু করতেন। তার বক্তৃতা ছিল সমসাময়িক তথ্যে ভরপুর অথচ বাহুল্য বর্জিত। সমাজতাত্ত্বিক দিক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি আমাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে অনেক উদাহরণ দিতেন। ক্লাসে স্যার এমনভাবে উদাহরণসহকারে পড়াতেন যে, আমরা সবাই বিষয়টি তাৎক্ষণিক বুঝতে পারতাম। তিনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোনো অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না। ত্ইাতো প্রায় প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে ক্লাস থেকে বের করে দিতেন। ফলে আমরা সবাই স্যারকে প্রচন্ড ভয় পেতাম। তবে সে ভয়ের সঙ্গে ছিল তার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।

ভূঁইয়া স্যার লেখালেখির চেয়ে বলতে বেশি পছন্দ করতেন। তার লিখিত গ্রন্থ সংখ্যা দুই। এগুলো হলো ‘স্যার সৈয়দ আহমদের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তা’ ও ‘সমাজবিজ্ঞানের তত্ত্ব: নির্বাচিত সমাজবিজ্ঞানীদের অবদান’ (সহলেখক আমি)। এছাড়া তিনি সামাজিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ১৫টি গবেষণা প্রবন্ধ রচনা করেছেন, যেগুলো দেশ-বিদেশের মানসম্মত জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। একাডেমিক জীবনে তিনি সরকারি অনুদানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রকল্প সম্পাদন করেছেন। এছাড়া তিনি দেশ-বিদেশের বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনার ও কনফারেন্সেও যোগদান করেছেন।

দায়িত্বশীলতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত ছিলেন প্রফেসর ভূঁইয়া। জীবনে তাকে কখনো কোনো দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে দেখি নাই। তিনি ছিলেন অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও দায়িত্বশীল ব্যক্তি। সততা ও আদর্শের পথে অবিচল থেকে তিনি তার উপর অর্পিত দায়িত্ব-কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করে গেছেন। যেমন, তার কোনো সহকর্মী উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশ গেলে তার পরিবারের সব দায়দায়িত্ব তিনি স্বেচ্ছায় কাধে তুলে নিতেন। এছাড়া কেউ কোনো সমস্যা নিয়ে তার কাছে গেলে তিনি তা সমাধানের জন্য অতি ব্যস্ত হয়ে পড়তেন।

শুধু সমাজবিজ্ঞান বিভাগ নয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে নিয়োজিত থেকে (যেমন- বিভাগের চেয়ারম্যান, হলের প্রভোস্ট, একাডেমিক কমিটির সদস্য সিন্ডিকেট, সিনেট সদস্য, শিক্ষক সমিতির সম্পাদক/ সভাপতি ইত্যাদি) ভূঁইয়া স্যার সমাগ্রিকভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহত্তর কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি সৎ, দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন।

ভূঁইয়া স্যারের সৌজন্যতা ও ভদ্রতা জ্ঞান ছিল শিক্ষণীয়। আমাকে তিনি শুরু থেকেই তুমি সম্বোধন করতেন। আমি মাস্টার্স শেষ করেই তাঁর পরামর্শে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএস-এ এমফিল কোর্সে ভর্তি হই। ভর্তির পরপরই তিনি একদিন তার অফিসের পিওনের মাধ্যমে আমাকে একটা চিঠি পাঠান। খামের উপরে ও চিঠির শুরুতে তিনি আমাকে জনাব রেজাউল করিম সম্বোধন করেন। তিনি ঐ পিওনকে বলেছিলেন ‘আইবিএস-এ গিয়ে রেজাউল করিম স্যারকে এই চিঠিটা দেবে’। ঐ পিওন আইবিএস-এ এসে রেজাউল করিম নামে কোনো স্যারকে খুঁজে না পেয়ে, আমাকে এসে জিজ্ঞাসা করেন যে ‘রেজা ভাই ভূঁইয়া স্যার রেজাউল করিম স্যারকে দেবার জন্য একটা চিঠি পাঠিয়েছেন, কিন্তু আমি এখানে এই নামে কোনো স্যারকে খুঁজে পাচ্ছি না। আপনি কী ওনাকে চেনেন?” আমি চিঠিটি হাতে নিয়ে দেখি আমার চিঠি। আমি তাকে বলি এটাতো স্যার আমাকে পাঠিয়েছেন। তখন পিওন আমাকে বলে ‘আপনি আবার স্যার হলেন কবে?’। এভাবেই স্যার অন্যকে সম্মানিত করতেন।

গুরুভক্তিতে ভূঁইয়া স্যার ছিলেন অতুলনীয়। তিনি তার বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী, শিক্ষকগণ ও কিছু শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়মিত টেলিফোনে যোগাযোগ রাখতেন। কাজটি তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে করতেন। তার শিক্ষকদের কেউ রাজশাহীতে একাডেমিক কাজে বা বেড়াতে এলে তিনি তাদের কোথায় রাখবেন, কি খাওয়াবেন, কিভাবে যাবেন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। তারা যেখানেই অবস্থান করুক না কেন, স্যারের বাসায় একবেলা খাবার খেতে হতো। আবার বিদায় বেলায় নানা প্রকার উপঢৌকন প্রদান করতে ভূলতেন না।

কাউকে উপহার প্রদান ছিল ভূঁইয়া স্যারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তার বাসায় কেউ কোনো কাজে বা বেড়াতে গেলে তিনি তাকে কোনো না কোনো উপহার দিতেন। এছাড়া বিভিন্ন উৎসব-পার্বনে তার প্রিয়জনদের নিয়মিত উপহার পাঠাতেন। রাজশাহীতে থাকার কারণে তিনি আম ও লিচুর মৌসুমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা তার সুহৃদদেরকে ঐসব ফল পাঠাতে ভূল করতেন না। আমি নিজে যে, তার কাছ থেকে যে কত বই, কলম, ডায়েরি, ক্যালেন্ডার, শার্ট, টাই পেয়েছি তার হিসেব নেই। আমার মতো অনেকেই এসব উপহার নিয়মিত পেত তার কাছ থেকে। এমনকি তার নিজের সন্তানদের কাছ থেকে পাওয়া উপহারও তিনি অন্যদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন।

জীবন চলার পথে তিনি আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছেন। যেমন- পোশাকে সবসসময় পরিপাটি থাকতে হবে। পোশাকের মূল্য যাই হোক না কেনো, তার সুন্দর করে পরিধান করতে হবে। যে কোনো অনুষ্ঠানে নির্ধারিত সময়ের ১৫ মিনিট পূর্বে উপস্থিত হতে হবে। কারো ব্যক্তিগত গাড়িতে চড়লে, যদি গাড়ির মালিক চালকের সিটে বসেন তবে অবশ্যই তার পাশের সিটে বসতে হবে। যে কোনো অফিসে গিয়ে প্রথমে নিজের পুরো পরিচয় দিয়ে কথা বলতে হবে ইত্যাদি। আসলে তাকে হারিয়ে আমরা হারিয়েছি একজন আদর্শ শিক্ষক, একজন অভিভাবক। সবার কাছে তিনি ছিলেন একজন আকর্ষণীয় চরিত্র। সত্যি বলতে কী, আজকে আমি যেখানে দাড়িয়ে আছি তার ভিত্তি হলো প্রফেসর ভূঁইয়া। স্যারের ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।

লেখক : সমাজ গবেষক ও শিক্ষক, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর।

খুলনা গেজেট/এমএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!