খুলনা, বাংলাদেশ | ১৫ চৈত্র, ১৪৩০ | ২৯ মার্চ, ২০২৪

Breaking News

  ময়মনসিংহের ত্রিশালে বাসের ধাক্কায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার তিন যাত্রী নিহত
  সাবেক সংসদ সদস্য ও সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা নজির হোসেন মারা গেছেন
  নওগাঁয় বিএসএফের গুলিতে নিহত বাংলাদেশির মরদেহ ফেরত
  যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত

অভয়নগরের আবাসিক এলাকায় আবারও কয়লা ড্যাম্পিং, জনস্বাস্থ্য চরম হুমকিতে

শাহিন আহমেদ, অভয়নগর

যশোর জেলার অভয়নগর উপজেলার শিল্প বন্দর নগরী হিসাবে খ্যাত নওয়াপাড়া পৌরসভাসহ রাজঘাট, তালতলা, সর্দার মিল, ভাঙ্গাগেট, মহাকাল, রথখোলা, চেঙ্গুটিয়া, বুড়োরদোকান, উড়োতলা, চাঁপাতলা, প্রেমবাগ, নগরঘাট, ঘোপেরঘাট, কজমিল, চলিশিয়া, পায়রা, আমডাঙ্গা, ধোপাদী, লক্ষীপুর, মশরহাটিসহ আশেপাশের এলাকার কিছু অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা আশে পাশের এলাকার পুকুর, ডোবা নালা, কৃষি আবাদি জমি ধ্বংস করে অবৈধভাবে কয়লা ড্যাম্পিং করছে। এতে করে বিপাকে পড়েছে সাধারণ মানুষ।

অভয়নগরের চেঙ্গুটিয়া গ্রামের আনোয়ার সরদার জানান, পার্শ্ববর্তী ভৈরব নদের তীরে মল্লিক বাড়ীর ঘাট, তরফদার পাড়ার ঘাটে ও ঘোপেরঘাট কালিবাড়ী ঘাটে দেদারছে চলছে কয়লা ড্যাম্পিং এর মহোৎসব। আশে পাশের জনবসতিতে সেখান থেকে উড়ে আসা কয়লার ধোঁয়া ও ধুলায় সৃষ্টি হচ্ছে কুয়াশাচ্ছন্ন অবস্থা। প্রশাসন ও আইন কানুনের তোয়াক্কা না করে বসতবাড়ি ঘিরে কয়লা ড্যাম্পিং করায় অনেকে বসতভিটা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। নানা কারণে উদ্বাস্তু হচ্ছে ভুক্তভোগী সাধারন মানুষ। যশোর খুলনা মহাসড়কের চেঙ্গুটিয়া থেকে রাজঘাট পর্যন্ত প্রায় ১২ কি.মি পর্যন্ত রাস্তার দু’ধারে, রেল লাইনের পাশে, পাওয়ার ষ্টেশনের গায়ে, নদীর ধারে, কৃষি আবাদি জমি, পুকুর বন্ধ করে ও আবাসিক জনবসতি এলাকায় এ সকল কয়লা ড্যাম্পিং করা হচ্ছে। আর এই কয়লার বিষাক্ত ধোয়া ও দূর্গন্ধে আচ্ছন্ন হয়ে থাকছে পুরো এলাকা। নওয়াপাড়া পৌরসভার মহাকাল, চেঙ্গুটিয়া এলাকায় কয়লার মজুদ সবচেয়ে বেশি।

মহাকাল গ্রামের বাসিন্দা মিজানুর রহমান জানান, এখানে আমার তিন প্রজন্মের বসবাস। কয়লার কারণে বসতবাড়িতে বসবাস দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। ঘর-দরজা, আসবাবপত্র, পোশাক পরিচ্ছদ কয়লার ধুলায় সয়লাব। এমনকি ভাত, তরিতরকারির সাথে খেতে হচ্ছে কলয়ার ধুলা। অভয়নগরের গাছপালা, রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ী সর্বত্রই কয়লার ছাপ। তারা অভিযোগ করেন কয়লার ডিপো সরিয়ে দেওয়ার দাবিতে বিভিন্ন সময় স্মারকলিপি, মানববন্ধনসহ প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন করা হলেও পরিবেশ অধিদপ্তর কিংবা কোন কর্তৃপক্ষই ব্যবস্থা নেয়নি।

তারা আরও বলেন, কয়লার বিষাক্ত ধুলা ও ধোয়ায় তাদের পরিবারের অনেকেই ফুসফুসজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, বিশেষ করে শ্বাসকষ্ট জনিত রোগে। বিশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায় সারাবিশ্বে প্রতিবছর কয়লার দূষনের কারনে ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২৪ হাজার এর উপর বেশী মানুষ মারা যায়, যার ফলে গত কিছুদিন পূর্বে বিশ্বের ১৯০ টি দেশ কয়লার ব্যবহার না করার অঙ্গীকার করেছে। কয়লার ড্যাম্পিং এর কারনে কয়লার থেকে উড়ন্ত ছাই (ফ্লাই আ্যাশ) বার্নারের নিচে জমা হওয়া ছাই (বাটম অ্যাশ), মারকারি, তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম, আর্সেনিক, ভারি ধাতু সহ বর্জ্য উৎপাদন হয়ে থাকে। কয়লা বেশি করে মজুদ করায় উচ্চ মাত্রার সালফার মিশ্রিত এসিড বৃষ্টি হয়ে থাকে। যে এলাকায় কয়লা মজুদ হয় তা থেকে বিষাক্ত পদার্থ সমূহের ভূগর্ভস্থ জলাধারে এবং খনি এলাকায় মাটির বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে পড়ে।

সরেজমিন দেখা যায়, রাজঘাট থেকে প্রেমবাগ পর্যন্ত তালতলা, নওয়াপাড়া বাজারের আশপাশ, গুয়াখোলা, কলাতলা, পাঁচকবর, মশরহাটি, ভাঙ্গাগেট, মহাকাল, বালিয়াডাঙ্গা, চেঙ্গুটিয়া, চাঁপাতলা এলাকায় দেড় শতাধিক কয়লার ডিপো গড়ে উঠেছে। প্রতিবছর প্রায় সাড়ে ৯ লাখ টন কয়লা নওয়াপাড়ার বিভিন্ন ঘাটে জাহাজে করে আসে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় ২০-২২টি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এই বিপুল পরিমাণ কয়লা নওয়াপাড়ায় আমদানি করে। পৌরসভার আবাসিক এলাকা ও গ্রামের মধ্যে কয়লা রাখায় দিন রাত সবসময়ই বাতাসে কয়লার ধুলা ও ধোয়া ছড়াচ্ছে। এসব এলাকায় মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। শিশু বয়স্কসহ সব বয়সের মানুষ ফুসফুসজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কয়লাবোঝাই কার্গো জাহাজ ও বার্জ (লাইটার জাহাজ) থেকে ফেলা বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে ভৈরবের পানি।

স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, কয়লার পোড়া দূর্গন্ধে মহাকাল, চেঙ্গুটিয়াসহ আশেপাশের বাতাস বিষময় হয়ে উঠেছে। মাঝেমধ্যে কয়লার স্তুপে আগুন ধরে যায়, তাছাড়া কয়লার ধুলা ঢুকছে মসজিদ, মন্দির ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোতে। আবাসিক এলাকায় কয়লা ড্যাম্পিং ঠেকাতে না পেরে ঘরবাড়ি বিক্রি করে পরিবার নিয়ে অন্যত্র চলে গেছে শতাধিক পরিবার।

পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জনবসতির দেড় কিলোমিটারের মধ্যে কয়লা ডিপো করা নিষিদ্ধ, জনবসতিপূর্ণ এলাকার বাইরে উচু দেওয়াল দিয়ে ঘিরে কয়লা ড্যাম্পিং করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জনবসতি পূর্ণ আবাসিক এলাকায় করা হচ্ছে পাহাড় সমতুল্য উচু উচু কয়লার ড্যাম্প।

কয়লা ড্যাম্পের বিষয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান শাহ ফরিদ জাহাঙ্গীরের নিকট মোবাইলে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, নওয়াপাড়া শিল্পাঞ্চল অবশ্যই ব্যবসা করবে কিন্তু আবাসিক এলাকায় ড্যাম্পিং করা যাবে না, যথাযথ নিয়ম মেনে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের কথা বিবেচনায় এনে যথাযথ নিরাপদ দূরত্বে ড্যাম্পিং করতে হবে।

এ বিষয়ে অভয়নগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ আমিনুর রহমান এর নিকট জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি আমার নজরে এসেছে পরিবেশ অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

কয়লার ড্যাম্পিং এর বিষয়ে নওয়াপাড়া পৌর মেয়র সুশান্ত কুমার দাস শান্তর নিকট জানতে চাইলে তিনি বলেন, সড়ক ও রেল লাইনের পার্শ্বের ড্যাম্পিংগুলো স্ব স্ব কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, আর আবাসিক এলাকার কয়লা ড্যাম্পিং এর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের অবহিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

অভয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ও আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাঃ আলিমুর রাজীব বলেন, কয়লা মানব দেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক।

তিনি আরও বলেন, কয়লার বিষাক্ত ধূলা মানব দেহের নিঃশ্বাসের সাথে প্রবেশ করে ফুসফুস, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগের প্রাদূর্ভাব ঘটায়। করনাকালীন সময় সরকারি কঠোর নির্দেশনার কারণে মুখে মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক থাকায় কয়লার বিষক্রিয়া থেকে সাধারণ মানুষ মোটামুটি রক্ষা পেলেও, যারা মাস্ক ব্যবহার করছে না তাদের জন্য কয়লার গ্যাস তাদের স্বাস্থ্যের জন্য চরম হুমকি স্বরুপ।

এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক হারুন অর রশিদ বলেন, বর্তমানে এ বিষয়ে কোন তথ্য হাতে আসেনি। তবে আমরা ওই এলাকায় পরিদর্শনে যাব। কয়লা ড্যাম্পিং বন্ধের জন্য এলাকাবাসীর যশোর খুলনা মহাসড়কে মানববন্ধন ও অবরোধসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করেছে যার স্মারকলিপি সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে দেওয়া হলেও সাময়িক কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি। স্থানীয় সাধারণ মানুষের দাবি অবিলম্বে আবাসিক এলাকার মধ্য থেকে কয়লা ড্যাম্পিং বন্ধ করে দূষণ বন্ধে কার্যকরি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পরিবেশবিদ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করা হোক।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!