খুলনা, বাংলাদেশ | ২৯ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ঘন কুয়াশায় শরীয়তপুর-চাঁদপুর নৌরুটে ফেরি চলাচল বন্ধ

সিঁধেল চুরি মামলায় ছয় মাসের জেল

এ এম কামরুল ইসলাম

বরিশাল সদর কোর্ট। তখনকার কোর্ট ইন্সপেক্টর জনাব জাহিদুর রহমান কোর্টের একটি মামলার রায় হাতে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। ঐ সময় আমরা তিনজন পিএসআই কোর্টে হাতেকলমে কাজ শিখছি। দুই বছরের শিক্ষানবিশ থাকাকালে তিন মাস কোর্টের কাজ শেখার নিয়ম ছিল। তাই তখন আমরা কোর্টে হাতেকলমে কাজ শেখায় ব্যস্ত ছিলাম।

কোর্ট ইন্সপেক্টর পুরনো একটা সিঁধেল চুরি মামলার রায় হাতে নিয়ে আমাকে খুঁজতে শুরু করলেন। সবাইকে ডেকে নিয়ে মামলার রায় দেখিয়ে মহা খুশিতে বলতে থাকলেন, “দেখো, দেখো পিএসআই মামলা তদন্ত করে চার্জশিট দিয়েছিল, সেই মামলায় আজ কোর্ট ছয় মাসের সাজা দিয়েছে। মামলাটি তদন্ত করেছিল পিএসআই কামরুল। ”

আমি এক প্রকার দৌঁড়ে গিয়ে তাঁর হাত থেকে মামলার নথি নিয়ে দেখলাম, হ্যাঁ আমারই হাতের লেখা এবং আমার তদন্ত করা জীবনের প্রথম মামলা। মনটা খুশিতে ভরে গেল। আমার ব্যাচমেটরা সামান্য মুখ কালো করলো। কোর্ট ইন্সপেক্টর সাহেব আমার হাত ধরে সোজা এসপি সাহেবের কাছে নিয়ে গেলেন। মামলার নথি এসপি সাহেবের হাতে দিয়ে বললেন, “স্যার পিএসআই কামরুল জীবনে প্রথম এই সিঁধেল চুরি মামলা তদন্ত করেছিল এবং সুন্দর তদন্তের পর ভালভাবে চার্জশিট দাখিল করায় কোর্ট ঐ চোরের ছয় মাস সাজা দিয়েছে। আমার চাকরি জীবনে এটা বিরল ঘটনা। সে একদিন ভাল অফিসার হবে। তাকে পুরস্কার দেয়া দরকার।”

পুলিশ সুপার জনাব সারোয়ার হোসেন সব সময় কম কথা বলতেন। তার মুখে কখনও উচ্চস্বরে হাসি দেখা যেত না। কোর্ট ইন্সপেক্টর সাহেবের কথা শুনে তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ মৃদু হাসলেন। আমাকেও ছোটখাটো ধন্যবাদ দিয়ে রিজার্ভ অফিসারকে ডেকে আমার সার্ভিস বহিতে ‘ডবল জিএস মার্ক’ দেবার নির্দেশ দিলেন। কোর্ট ইন্সপেক্টর সাহেব আমাকে নিয়ে আবার কোর্টে ফিরে এসে কোর্টের সকল অফিসার ও ফোর্স ডেকে আমাকে আবার সম্মানিত করলেন। আমিও বেশ উৎসাহিত হলাম।

এই সিঁধেল চুরির ঘটনা ও আমার মামলা তদন্ত নিয়ে কিছু কথা জানানো দরকার বলে মনে করি। পুলিশের এসআই পদে চাকরি কনফার্ম করতে এক বছর সারদায় হাড়ভাঙা ট্রেনিং করার পর জেলায় গিয়ে আরো দুই বছর হাতেকলমে কাজ শিখতে হয়। এই দুই বছরের প্রথম ছয় মাস থানায় ও শেষ ছয় মাস আবার থানায় হাতেকলমে কাজ শিখতে হয়। প্রথম ছয়মাস শুধু থানার ফাইলপত্রের ধারণা নিতে হয়, কোন মামলা তদন্ত সাধারণত করতে দেয়া হয় না। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে একটু ব্যতিক্রম হয়ে গেল৷

কোতোয়ালি থানার ওসি ছিলেন জনাব আব্দুল জব্বার সাহেব। আমি কোতোয়ালি থানায় শিক্ষানবিশ এসআই হিসেবে যোগদানের পর থেকে ওসি সাহেবসহ সকল অফিসার আমাকে ভীষণ স্নেহের চোখে দেখতেন। ওসি সাহেব প্রায়ই তাঁর মটর সাইকেলে করে আমাকে বিভিন্ন কাজে নিয়ে যেতেন। অন্যান্য অফিসারবৃন্দ একই কাজ করতেন। অর্থাৎ আমাকে নিয়ে এক প্রকার কাড়াকাড়ি লেগে যেতো।

ওসি জনাব আব্দুল জব্বার সাহেব একদিন এসপি সাহেবের অফিস ঘুরে থানায় এলেন। একটু ভারি ভারি কন্ঠে থানার সেরেস্তায় কর্মরত মুন্সীকে ডেকে বললেন, “পিএসআই কামরুলকে ছোটখাটো মামলা তদন্ত দিতে হবে। এসপি স্যারের হুকুম।”

আমার চাকরি বয়স তখন সবেমাত্র এক মাস। হয়তো সে কারণে ওসি সাহেব আমাকে মামলা তদন্ত দিতে আগ্রহী ছিলেন না। এসপি সাহেব কি কারণে আমাকে মামলা তদন্ত করার বিশাল দায়িত্ব দিতে চেয়েছিলেন তা আমি জানতাম না। যাহোক অনিচ্ছায় হলেও ওসি সাহেব আমাকে মামলা তদন্তের দায়িত্ব দিতে মনস্থির করলেন।

এরমধ্যে বরিশাল শহরের একটি প্রভাবশালী বাড়িতে জানালার গ্রিল কেটে চুরি হলো। পুলিশ সাধারণত এসব মামলা এড়িয়ে চলে। আবার চুরি মামলা কোন অফিসার তদন্ত করতে চায় না। তার পিছনে কারণ অনেক আছে। যেমনঃ এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে মাসিক অপরাধ সভায় জবাবদিহি করতে হয়। চোর ধরা না পড়লে বা চোরাই মালামাল উদ্ধার না হলে কৈফিয়ৎ দেয়া লাগে। তাছাড়া চুরি বা ডাকাতি মামলা তদন্তে কোন আর্থিক লাভের সম্ভাবনা থাকে না। নানাবিধ কারণে ওসি সাহেব মামলা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে চান এবং দারোগা সাহেবরা এসব মামলার তদন্তভার নিতে চান না। তাই এই সিঁধেল চুরি মামলার তদন্তভার আমার উপর দিয়ে ওসি সাহেব তাঁর দায়িত্ব পালন করলেন। অন্যান্য দারোগা সাহেবরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। আমি মনে মনে অখুশি হলেও প্রতিবাদ করার সাহস হলো না। থানার মুন্সি সাহেব আমাকে মামলার কপি বুঝিয়ে দিলেন।

আমি মামলা তদন্তের আগামাথা কিছুই বুঝতাম না। এক প্রকার অসহায়ের মতো এজাহারের কপি হাতে নিয়ে বার বার পড়ে ঘটনা বুঝতে চেষ্টা করলাম। শেষ পর্যন্ত রাতে পুলিশ ক্লাবে ফিরে যাবার সময় মামলার কপিটি সাথে নিয়ে গেলাম। রাতের খাবার টেবিলে বসে পুলিশ ক্লাবে আমার সাথে বসবাসরত সিআইডি অফিসার এসআই বজলুর রহমান সাহেবের কাছে সব কথা খুলে বললাম। তিনি আমাকে ভীষণ স্নেহ করতেন। আমার অসহায়ত্ব দেখে তিনি আমাকে সাহস দিয়ে বললেন, “আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আমি আপনাকে সাহায্য করবো। মামলা তদন্তের সকল বিষয় আপনাকে শিখিয়ে দিব এবং মামলার ডায়েরি আমি বসে থেকে লিখিয়ে দেব।”

শুধু তাই নয়, খাবার শেষে তিনি মামলার এজাহারের কপি মন দিয়ে পড়ে আমাকে এমনভাবে আশ্বস্ত করলেন যে, আমি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে গেলাম।

পরদিন সকালে মামলার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বজলু ভাইয়ের নির্দেশ মোতাবেক খসড়া মানচিত্র তৈরী করে, সাক্ষীসাবত ইত্যাদি সংগ্রহ করলাম। শুরু হলো সিঁধেল চোর ধরে চোরাই মালামাল উদ্ধার করার চেষ্টা।

দিন কয়েক চলে গেল৷ চোর ধরা বা চোরাই মালামাল উদ্ধার করা কিছুই হলো না। বজলু ভাইয়ের পরামর্শ কাজে লাগিয়েও কোন ফল হলো না। থানার কেউ আমাকে সাহায্য করা তো দূরের কথা, বরং উপহাস করতে শুরু করলো। চোরাই মালামাল উদ্ধার করতে না পারার যন্ত্রণা আমাকে কুরে কুরে খেতে লাগলো। মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় এসপি সাহেব সিঁধেল চুরি মামলার হালহকিকত জানতে চাইলে কি উত্তর দেব, সেটার চেয়ে বেশি মনে পড়তে লাগলো মামলার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের কথা। তাদেরকে কী বলে সান্ত্বনা দেব তাই ভেবে সারাক্ষণ লজ্জিত হতে থাকলাম।

হঠাৎ একদিন সকালে থানায় গিয়ে দেখি একজন মানুষ হাজতে শুয়ে চিৎকার করছে। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই মুন্সি কনস্টেবল ওই লোকটাকে দেখিয়ে বললো, “ওসি সাহেব এই আসামিকে আপনার সিঁধেল চুরি মামলায় চালান দিতে বলেছেন। গতরাতে চুরি করতে গিয়ে পাবলিকের হাতে ধরা পড়েছে। পাবলিক তাকে গণধোলাই দিয়েছে৷”

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম। মুন্সির কাছে এই ঘটনার বিবরণ শুনে বুঝলাম আমার মামলার ঘটনাস্থল ও আজকের চোর যেখানে ধরা পড়েছে সেই ঘটনাস্থলের দূরত্ব অনেক। তারপর লোকটি যেভাবে কাতরাচ্ছে তাতে মারা যাওয়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাই ভাবলাম তাকে চুরি মামলায় চালান দেব কিনা সেটা পরের কথা, আগে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করাই। সকল ঝামেলা মাথায় নিয়ে তাকে একটা কনস্টেবলসহ রিক্সায় করে হাসপাতালে রওনা হলাম। সে যদি রাস্তায় মারা যায় তাহলে সকল দায়দায়িত্ব আমার ঘাড়ে পড়তে পারে, তা আমি জানতাম না। কিন্তু আমার সাথে থাকা কনস্টেবল আমাকে সেকথা মনে করিয়ে দিলো। তাই আবার থানায় ফিরে ঐ বিজ্ঞ কনস্টেবলের পরামর্শ মত থানার ডায়েরিতে সবকিছু লিখে তারপর আবার হাসপাতালে রওনা হলাম। রাস্তায় যেতে যেতে সন্দেহভাজন ধৃত লোকটিকে চুরির বিষয়ে জানতে চাইলে সে একবাক্যে চুরির কথা স্বীকার করলো। আমি তখন আমার তদন্তে থাকা পূর্ববর্তী মামলার ঘটনার কথা বললে সে জানালো, ঐ চুরিও সে করেছিল। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো। মনে হয়েছিল- সে আবার মার খাবার ভয়ে সকল চুরির দায়ভার নিজের কাঁধে তুলে নিচ্ছিলো। তাকে বললাম, “তুমি কোর্টে গিয়ে একথা স্বীকার করবে। সে বিনা দ্বিধায় বললো, “হ্যাঁ,আমি স্বীকার করবো।”

বরিশাল সদর হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে সার্টিফিকেট নিয়ে ঔষধ কিনে তাকে খাইয়ে থানায় ফিরে এলাম। তাকে আমার তদন্তাধীন মামলায় চালান করতে মন সায় দিচ্ছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দিতেই হলো। ওসি সাহেবের নির্দেশে আমি নিজেই তাকে কোর্টে নিয়ে গেলাম। সাথে একজন মাত্র কনস্টেবল ছিল।

কোর্ট ইন্সপেক্টর সাহেব আসামির অবস্থা দেখে বললেন, “মেডিকেল সার্টিফিকেট এনেছেন? আসামির অবস্থা খারাপ। এ অবস্থায় কোর্টে নিলে ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব আমাকে ধরবেন। অতএব আপনি নিজেই তাকে কোর্টে হাজির করেন।”

উপায়ান্তর না দেখে আমি নিজেই ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের কাছে হাজির হয়ে সব সত্যি কথা তাঁর খাসকামরায় বসে খুলে বললাম। তখন বিচারিক আদালতের ম্যাজিষ্ট্রেট ছিলেন জনাব সালেহ আহসান। এই এক মাসের চাকরি জীবনে তিনি আমাকে চিনে গিয়েছিলেন। সব কথা শুনে তিনি বললেন, “আসামিকে এই অবস্থায় কোর্টে উঠালে উকিল সাহেবরা হৈচৈ করতে পারে। অতএব আপনি অপেক্ষা করেন আমি খাসকামরায় বসে তার কথা শুনবো।”

কিছুক্ষণ পরে ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব তাঁর খাসকামরায় আসামিকে জিজ্ঞেস করায় সে চুরির কথা স্বীকার করলো। ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব তার বক্তব্য ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় লিপিবদ্ধ করলেন এবং আমাকে একটা ফটোকপি দিয়ে আসামিকে হাজতে পাঠিয়ে দিলেন। আমিও চিন্তামুক্ত হলাম৷ আসামির দোষ স্বীকারোক্তির কপি নিয়ে ওসি সাহেবের হাতে দিতেই তিনি অবাক হলেন। থানায় উপস্থিত সকল অফিসার ও ফোর্স আমাকে ধন্যবাদ দিলেন। কেউ কেউ সামান্য ঈর্ষান্বিত হলেন।

আমার জীবনের সেই প্রথম তদন্ত করা মামলার বিচারের রায় হয়েছিল আমি যখন কোর্টে প্রশিক্ষণে ছিলাম তখন এবং কোর্ট ইন্সপেক্টর সাহেবের সুপারিশে এসপি সাহেব আমাকে পুরস্কার দিয়েছিলেন। সন্দেহভাজন চোর নিজ ইচ্ছায় দোষ স্বীকার করায় চুরির ঘটনা প্রমাণ করতে আমাকে তেমন কষ্ট করতে হয়নি। শিক্ষানবিশ অফিসার হয়েও এসপি সাহেবের বিশেষ নির্দেশে কিছুটা প্রথার বাইরে মামলা তদন্তের দায়িত্ব পেয়ে আমি আমার দায়িত্ব কতটুকু পালন করতে পেরেছিলাম সেটা মূখ্য বিষয় ছিল না। পুলিশের খাতায় অজ্ঞাত চুরির মামলায় আসামিকে সাজা করানো এক প্রকার দুঃসাধ্য কাজ হওয়ায় সেই সাফল্য আমাকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।

আনন্দ

একে অজ্ঞাত সিঁধেল চুরির মামলায় আসামির সাজা (এমন ঘটনা পুলিশের খাতায় খুব কম হয়), তারপর জীবনের প্রথম তদন্ত করা মামলা। তাও আবার পিএসআই হিসেবে প্রথম মাসেই। এমন ঘটনায় সবারই আনন্দ হওয়ার কথা।

বেদনা

সেই সাজাপ্রাপ্ত আসামির কথা আমার আজও মনে পড়ে। সে ঐ চুরি করেছিল কিনা তা আমি এখনও নিশ্চিত নই। পাবলিকের হাতে গণধোলাই খাবার পর আরো মারের ভয়ে সে আমার মামলায় দোষ স্বীকার করেছিল কিনা সেই চিন্তা আমাকে এখনও তাড়া করে। আমি যদি ঐ লোকটিকে অহেতুক জেল খাটিয়ে থাকি তাহলে আল্লাহ যেন আমাকে ক্ষমা করেন। চলবে…

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার। (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, অব.)




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!